‘চিহ্ন’ একটি প্রকাশনা, একটি পত্রিকা, একটি চিন্তাশীল আড্ডাক্ষেত্র। প্রতি ছয় মাস পর নিয়মিত বের হয় ‘চিহ্ন’র নতুন সংখ্যা। নতুন এবং পুরাতন লেখকদের মিশেলে এ পর্যন্ত ‘চিহ্ন’র প্রকাশিত সংখ্যা ৩৩ টি। ‘চিহ্ন’প্রকাশনা থেকে নিয়মিত বই ও পত্রিকাও বের হয়। কবি-প্রাবন্ধিক জুলফিকার মতিন, কবি শেখ আতাউর রহমান কিংবা মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদের মতো প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি তুহিন ওয়াদুদ, কুমার দীপ, সজল সমুদ্রসহ অনেক নবীন এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের বই প্রকাশ করেছে ‘চিহ্ন’প্রকাশন। ‘চিহ্ন’র সর্বশেষ এবং ৩৮তম প্রকাশনা কবি ও প্রাবন্ধিক জুলফিকার মতিনের ‘বাঙালি মুসলমান ও তার মন। এছাড়া ‘চিহ্ন’ একটি কিশলয় সাহিত্যক্ষেত্রও। অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘চিহ্ন’ সফট্ কপি আকারে পাওয়া যায়। ‘চিহ্ন’র যাবতীয় কার্যক্রম ‘চিহ্ন’ওয়েবপেজের মাধ্যমে বিস্তারিত জানা যায়।
মানিক, তারাশঙ্কর নাকি বিভূতি—শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় কে এগিয়ে? আর তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের হাতিয়ারই বা কী? তাঁদের লেখার মূল বিষয়বস্তু কী? তাদের নিজেদের দর্শনগুলো কেমন? তাদের লেখায় এর প্রভাবগুলো কতটা শক্তিশালী? নাকি তারা আপন আপন জায়গায় প্রত্যেককে শ্রেষ্ঠ! কে বেশি মেধাবী, মানিক না বঙ্কিম? চলে তর্ক, চলে আড্ডা। ‘চিহ্ন’আড্ডা। ‘চিহ্ন’র রবিবারের আড্ডা। স্থান ১৩০, শহীদুল্লাহ্ কলাভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আড্ডারু প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। আর আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যিনি বসে থাকেন তিনি ‘চিহ্ন’প্রধান ও ‘চিহ্ন’সম্পাদক শহীদ ইকবাল। তাকে আড্ডা চলাকালীন সময়ে মনে হবে খুব ব্যস্ত। যদিও আড্ডায় তর্ক জমে উঠলে মুখ টিপে টিপে হাসেন। আর আড্ডারুরা নিজেদের কথা শেষ করে সমাধানের আশায় ‘চিহ্ন’প্রধানের দিকে তাকান। অবশেষে ‘চিহ্ন’প্রধান আলোচ্য বিষয়ে যে আলোচনা করেন তাতে অনেক প্রশ্নের সমাধান আসে, সেই সাথে আসে অনেক নতুন প্রশ্ন, আসে আলো। ঘটে ভাবান্তর। বিষয়ের গভীরে গিয়ে কত দিক থেকে, কত আঙ্গিকে ব্যাখ্যাদানের প্রচেষ্টা যেন। আড্ডারুরা যে আলোটুকু ফুয়েল হিসেবে পান তাই নিয়ে তাদের কী বাহাদুরী! হাটে-ঘাটে-মাঠে সৃষ্টির অন্বেষণ। চিত্তের উন্নয়ন। নিজেকে লেখক হিসেবে আবিষ্কার করা। কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সিনেমা, পথনাটক, মঞ্চনাটক ইত্যাদি হয় আড্ডার বিষয়।
আগেই বলেছি, ‘চিহ্ন’র গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ছোটকাগজ ‘স্নান’। ‘চিহ্ন’কর্মীদের মধ্যে একজন হয় ‘স্নান’ সম্পাদক। আর যাকে ‘স্নান’ সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয় তিনি হয়ে যান অন্য কেউ। অন্য মানুষ। একজন সাধারণ ছেলের অন্য মানুষ হয়ে যাওয়ার মন্ত্র ‘স্নান’-সম্পাদনা। তাকে দেখে মনে হয় যেন সে ঐশ্বরিক মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষ। আপাত তাকে দেখে মনে হয় সে ময়লা, রুগ্ন, বেপোরোয়া, কারো কারো কাছে পাগলও মনে হতে পারে। ‘স্নান’ যেন তার কাছে মশাল। অন্ধকার দূর করবে সে। তার কাঁধে তখন কত দায়িত্ব। প্রথমত নিজেকে দায়িত্বশীল, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক হিসেবে মেনে নেওয়া। আর সেই দায় নিয়ে লেখক খুঁজে বের করা। যারা লিখতে পারেন না তাদেরকে, কী করে লিখতে হয়, কী করে ভাবতে হয়, তাকে কেন লিখতে হবে, মানুষ হিসেবে তার দায় কোথায় ইত্যাদির ভাবনা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। আর এই প্রক্রিয়ায় চার মাস পর ‘স্নান’-এর নতুন সংখ্যা বের হয়। সাথে অনেক নতুন লেখক। ‘স্নান’-এ লিখতে লিখতে ওই লেখকরাই ক্রমশ ‘চিহ্ন’-এ লেখা শুরু করে। তৈরি হয় ‘চিহ্ন’র লেখক ঘরানা। এবং এই প্রক্রিয়ায় ১৮ বছর ধরে ‘চিহ্ন’র কর্মশীলতা তৈরি হয়েছে।
কার্যত, ‘চিহ্ন’-পত্রিকাকে ঘিরেই এ আয়োজনগুলো চলে। বছরব্যাপী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ কলাভবনে একগুচ্ছ তরুণ স্বপ্নাশ্রয়ী এ কাজে নিরত হন। স্মর্তব্য যে, ‘চিহ্ন’-পত্রিকা নিছক কোনো লেখা বা লেখকের সংকলন নয়। এর পরিকল্পনায় পূর্ণ দার্শনিক-চিন্তা বিরাজমান। প্রায় ৬০% তরুণের অংশগ্রহণ এর প্রাণশক্তি। বাকিরা বাংলা ভাষাভাষী যশস্বী লেখক। গত ৩৩টি সংখ্যায় পত্রিকাটির বিষয় ও প্রচ্ছদ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ের নান্দনিক গেট-আপ বাংলাভাষিক অঞ্চলে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পত্রিকাটি প্রতিটি সংখ্যায় ক্রোড়পত্র হিসেবে একটি শিরোনাম বেছে নেয়। এছাড়া আছে শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চার খবরাখবর, কী লিখি কেন লিখি সিরিজ, নির্বাচিত পুস্তক ও পত্রিকা পরিচিতি, বই ও পত্রিকা সমালোচনা ও কিছু নির্ধারিত ধারাবাহিক। তবে বিভিন্ন সময়ে রুচির বদল ঘটিয়ে চিহ্নে বিষয়ের পরিবর্তন আনে। বর্তমানে এর ৩৪ সংখ্যার কাজ চলছে। এবার এর বিজ্ঞান বিষয়ক একটি বিভাগ যুক্ত হতে যাচ্ছে। এভাবে পরিকল্পনামাফিক নবীন ও প্রবীনের সমন্বয়ে ‘চিহ্ন’র যাত্রা অব্যাহত আছে। বস্তুত, ‘চিহ্ন’ বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাগজ নয়, এতে মানসম্পন্ন সকলের লেখাই মুদ্রণের প্রয়াস থাকে। তবে প্রান্তিক ও কেন্দ্র-বিরোধী একটি প্রবণতা পত্রিকাটি লালন করে। নানাভাবে তা চর্চারও হয়। ‘চিহ্ন’ তার অগ্রযাত্রায় চিন্তাশীল সকলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে।