স্টেলা নেই

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্যnoname১.

আমি যখন শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রা রোগের উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম, সেদিন আমার সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী এবং বাবা। সে অনেকদিন আগের কথা। ডাক্তার দেখিয়ে আমরা পাশের একটা ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে বসলাম। হাসপাতালের পাশে সবসময়ই আমি এমন রংচঙে রেস্টুরেন্ট থাকতে দেখেছি। উজ্জ্বল হলুদ রঙের রিসিপশন,কমলা রঙের দেয়ালের সঙ্গে লাল উর্দি পরিহিত কর্মীরা একটা আনন্দের আবহ তৈরি করে। কোথায় যেন পড়েছি নোনতা খাবার মস্তিষ্কে আনন্দের উদ্দীপনা দেয়। কথাটা মনে হয় মিথ্যে না। খাবার খেতে খেতে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। চিজ বার্গার ভেঙে মুখে নিয়ে আমার স্ত্রী ভরসা দেয়ার কণ্ঠে বলল,

—দেখলে তো, তোমার শরীর একদম ঠিক আছে! সমস্যাটা তোমার মনে। মনটা শক্ত রাখো, আমাদের সঙ্গে হেসেখেলে বেড়াও, দেখবে, আর শ্বাসকষ্ট হবে না, আর ভয় লাগবে না!

ওর কথায় ভরসা পেলাম। আমার বাবাও মিল্কশেকে চুমুক দিয়ে সস্নেহ কণ্ঠে সাহসের পরশ জুগিয়ে গেলেন,

—শোন, তুই এত চিন্তা কইরবিনে বুঝিছিস, আরে আমরা তো আছিই! আমরা থাকতি তোর এত চিন্তার কী আছে?

খাবারের শেষ পর্যায়ে হাসি-ঠাট্টা রদ করে গম্ভীর মুখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে করিয়ে দিল আমার স্ত্রী,

—শোনো, ওষুধগুলো কিন্তু খুব নিয়ম করে খাবে। আমি তোমাকে প্রতিবেলা মনে করিয়ে দেব। আর ডাক্তারের ওই কথাটা মনে থাকবে তো? নিজের ইচ্ছায় ওষুধ ধরাও যাবে না, নিজের ইচ্ছায় ওষুধ ছাড়াও যাবে না। ওষুধ ধরার, আর ছাড়ার, দুটোরই নিয়ম আছে। মনে থাকবে তো?

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম।

২.

কতরকম ওষুধ! কত বিচিত্র তাদের রং, বিচিত্র তাদের নাম! প্রতিদিন প্রায় দশরকম ওষুধ খেতে হবে আমায়। প্রথমদিকে গুলিয়ে যেত। তারপর একটা সময় অভ্যেস হয়ে গেল। বছরের পর বছর, বছরের পর বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমার বসবাস। কয়েক মাস পরপর ডাক্তারের কাছে ভিজিটে যেতে হতো। ডাক্তার আমার অবস্থার উন্নতি দেখে একটার পর একটা ওষুধ কমিয়ে দিতে লাগলেন। প্রতিবার ডাক্তার দেখিয়ে আমরা সেই রংচঙে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে নিই। একেকটা ওষুধ কমে, আর আমি ওদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখতে পাই। আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি। এখন রাতের বেলা ভালো ঘুম হয়, অযথা ভয় পাই না, দম আটকে আসে না।

৩.

আজ আমি ডাক্তারের কাছে একাই এসেছি। গত সাত বছরে তার বয়স বাড়লেও কর্মচাঞ্চল্য কমেনি। আগের মতোই আন্তরিকভাবে কথা বলেন।

—তা কী খবর আপনার? আজকে একাই এসেছেন? বাবা কই?

—তিনি অসুস্থ। শয্যাশায়ী।

—আচ্ছা, আর স্ত্রী?

—সেপারেশন হয়ে গেছে।

—ওহ! এনিওয়ে!

তিনি আমার অসুখের বিবরণ নেয়া শুরু করলেন।

—আপনি এখন কী কী নিচ্ছেন যেন? এক বেলা স্টেলা, তাই না? আর কিছু না তো? ওটা আর নেয়া লাগবে না।

—আর কোনোওষুধ নেয়া লাগবে না আমার?

—না।

তিনি স্মিত হেসে জানালেন।

ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর অভ্যাসবশত তাকালাম সেই রংচঙে রেস্টুরেন্টটার দিকে। ওটা আজকে বন্ধ। অনেকদিন ধরেই বন্ধ মনে হয়। মরচে ধরা লোহার দরজায় সময়ের অভিমান জমা। আমি ওখান থেকে ওসুধের দোকানে চলে গেলাম। গত ছয় মাস ধরে আমাকে একটাই ওষুধ কিনতে হয়েছে। স্টেলা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমাকে এখন আর কোনোওষুধ নিতে হবে না! তারপরেও মনের ভুলে জিজ্ঞেস করে বসলাম।

—স্টেলা আছে?

—না, নেই।

বড় ক্লান্ত আর বিপন্ন লাগল। আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করলাম। ওকে ফোন করা আমার বারণ। জিজ্ঞেস করলে কী বলব?
—কী ব্যাপার, তুমি আবার ফোন করেছ যে? ঝাঁঝাল শীতল কণ্ঠে তার জিজ্ঞাসা।
—বীথি...স্টেলা নেই।

আমার শোক শুধু স্টেলার জন্য না। আমার মন খারাপ করছে যিওনিল, জোলিয়াম, কোয়াইট, ভিটামিন সি সবার জন্য। অন্যদের মতো যথারীতি যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!