স্বপ্ন

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্যnonameঘুমের মধ্যে ইরতিয়া স্বপ্ন দেখছিল। বিশাল একটা বিল্ডিংয়ের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে। চারদিকে অজস্র বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন চলছে ঘড়ঘড় করে। সিলিংয়ের সঙ্গে অসংখ্য টিউবের আলো দিনের আলোর প্রখরতাকেও ম্লান করে দিচ্ছে। তার ডান পাশেই একটি চল্লিশোর্ধ্ব শুকনো দেহের নারী সেলাইমেশিনে কাজ করে যাচ্ছেন একমনে। সূর্যালোকের অভাবে শরীরের চামড়া সাদা হয়ে গেছে! দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মহিলা লো-প্রেশারের রোগী! জামার কলার লাগাতে লাগাতে হাত কাঁপছিল ঠিরঠিরিয়ে।

ইরতিয়া প্রশ্ন করল, ‘আপনার নামটা কী বলবেন?’মহিলা হকচকিয়ে উঠল। কাজের ফাঁকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি মরজিনা! কিন্তু আফনে!’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মহিলার।

‘আমি ইরতিয়া আপনাদেরই মতো, সাধারণ এক নারী।’

‘ওহ! আমি ভাবছিলাম মালিকের লোক!’

‘আপনাদের মালিক কে?’

‘তিনিও আমাগো লাহান মানুষ! হাত দুইখান, পাও দুইখান! কিন্তু তার লগে আমাগো ফারাক; আমাগো ছেঁড়া পিন্ধন, তাগো পোশাক ঝকমইক্যা, দামি! আমরা পেডের ভুখে কাতরাইলেও খাওন পাইনা, তিনারা গলা পর্যন্ত খাইয়া আবার হজমি খান, কোল ডিরিংস খান! আমরা বস্তিতে থাহি আর তিনারা পাঁচতলার আলিশান বাড়িতে।’

‘কিন্তু আপনাদের তো ঠিকমতো মজুরি দেয়।’

‘দ্যায় সময়মতন! তবে দরকারমতন নয়! যেট্টুক দিলে হাড্ডি মাংসে বেড়ান্যা চামড়ার এই শইলডা ধুইকতে ধুইকতে বাঁইচা থাকব অইটুকই! ওদের উপ্রে উইঠতে হলে আমাগোর তৈয়ারি সিঁড়িটা ডিঙাইতে হয়, তাই আমাগো বাঁচাই রাখে। আমরা বাঁইচ্চা থাইকলেই লাভ। ওদের রসদ জোগাইতে পারি! আমরা কাজ করি, তারা ব্যাংক ভরায়! অথচ সবাই বলে আমরা গার্মেন্টের চাকরি করে নিজের পাওয়ের ওপর খাড়াইছি! স্বাধীন অইছি! দ্যাশের মাইয়ারা আগাই গ্যাছে!...’ একটু দম নিল মহিলা!

‘আপনাদের সবার কি একই অবস্থা?’

‘হয়তো সবার! ওনারা ব্যবসায়ী তার উপ্রে লোভী! লোভের শিলপাডায় আমরা মরিচ পিষ্যা মরতাছি! তার ওপর ম্যানেজমেন্টের কত নজরদারি! শকুন-চোখা, শেয়াল-চোখা, নেকড়ে-চোখা! সব রসুনের কোঁয়া একজাগাত অইছে!’

‘মানে!’

‘অই যে দেখত্যাছেন তিন নম্বর লাইনে দুইজনের পিছনে, হেয় আমার বইনঝি। বাপ তার রাজার মেস্তরি আছিল। ছাদ ঢালাইতে গিয়া আতকা মাডিত পইড়া গ্যাল! আল্লায় বাঁচাইছে! মরে নাই! বাম পাওয়ের মালাডা বাইরাই গ্যাছে! এহন হুইল চেয়ার সম্বল! তাই বইনঝিরে নিয়া আসলাম গার্মেন্টে ভর্তি করানের লিগ্যা! মাইয়া আমার মাশাল্লা গায় গতরে সোন্দর! পড়ছেও আষ্টো-কেলাস! ম্যানাজারকে কইতে হেয় ভর্তি নিয়া নিল! কিন্তু পইড়ল হের বদনজর! আসাতক কয়দিন বইনঝির টেবিলের পাশে ঘুরঘুর করল ম্যানাজার! তাবাদে চোক্ষের কি চাউনি গো! যেন তারে মনের মইদ্যে নেংটো করে বুক পাছা বাল তিল সব দ্যাখতাছে! কী শরম! কী শরম!’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে মহিলা আবার বলছে,‘কদিন বাদে বইনঝিরে অফিসে ডাইক্যা নিল ম্যানাজারে! অর গায় হাত দিল হারামি! জড়ায়ে ধইল্ল বুকে। চিক্কুর পাইরা মাইয়া আমার ফ্লোরে চইলা আইল! আমরা সব মাইয়ারা মিল্যা পরতিবাদ করলাম। মালিকের অফিসে গেলাম। মালিক ম্যানাজারকে তলব করল। ম্যানাজার সব অস্বীকার করল।কইল,কর্মীরা ইউনিয়ন করতাছে, আর ফ্যাক্টরি বন্ধ করার হুমকি দিয়া ন্যাতারা টাকা খাইবার লাইগা এতসব বাহানা করতাছে!

মালিকের চোখ জ্বইলা উঠল গমগইম্যা আগুনের লাহান! বলল, এতবড় কথা! যে পাতে খাস, সে পাতে বমি করিস তোরা! নিমক হারামির দল! দল পাকাইবার চাস? মনে আছে ‘মাসুম এপারেলস’র কথা! ওদের দশ পাতি নেতা কর্মী এখন জেল খাটতাছে! তোরাও কি এমনি চাস!

পেছনের সব সুরসুর কইরা পলানতি দিল! আমি আর বইনঝি ছাড়া আর কেউ নাই মালিকের রুমে!

নেকড়ে-চোখা ম্যানাজার আবারও চাইয়া আছে বইনঝির দিকে! মালিক হুঙ্কার দিলেন বাঘের মতন! কাজে যা!

আমি আর বইনঝি নিজেরার টেবিলে চলি আইলাম।

বিচার কাঁন্দে বিলাপ ধইরা! আমাগো আন্ধাইরা গলি দিয়া ঢুকে ক্ষুধা, ভুখা পেডের ভিতর অম্বল হয়! দুঃখ আমাগো ঘুম পাড়ায়, বিহানে কষ্ট আমাগো দৌড়াইয়া মারে! ফতোয়াবাজরা বলে, বেলাজ হারামজাদিদের খানকিপনায় পাপে ডুবছে দ্যাশদুইন্যা!...’

ইরতিয়ার ঘুমটা ভেঙে গেল। জানালার ফাঁক গলে উঠন্তি সূর্যের আলো এসে পড়েছে বিছানায়! মনের ভেতর কী যেন একটা খচখচ করছে। কী একটা স্বপ্ন দেখেছিল, মনে করতে পারছে না।