রাশিয়ার গল্প

মঙ্গলের ফুল | কনস্তানতিন পাউস্তোভস্কি

কনস্তানতিন পাউস্তোভস্কি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের মহান কথাশিল্পী। দীর্ঘ ৫০ বছর সাহিত্যচর্চা করে রেখে গেছেন বহু অনবদ্য রচনা। ১৮৯২ সালের ৩১ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৬৮ সালের ১৪ জুলাই। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মানুষ হন। অক্টোবর বিপ্লবের সময় তিনি ছিলেন পত্রিকার সংবাদদাতা। ১৯২৩ সালে রাশিয়ান টেলিগ্রাফিক এজেন্সির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাউস্তোভস্কি সবসময় নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর খুব কাছাকাছি ছিলেন। তাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নায় যেন তিনিও অংশ নিতেন, এ জন্যে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে বলা হয় খুবই জীবন্ত। নিজের সম্পর্কে বলেছেন : আমার লেখক-জীবন শুরু হয় সবকিছু জানা ও সবকিছু দেখার ইচ্ছে থেকে। কিশোর বয়সে আমার ভীষণ টান ছিল অসামান্যের প্রতি। অসামান্যের এই টান ছোটবেলা থেকেই আমাকে ব্যাকুল রাখত।Dilwarগত বছর গরমকালে বোরোভোয়ে হ্রদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক পাইন বনের মধ্যেকার ফাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিলাম। সব জায়গাতেই গ্রীষ্মের সুগন্ধে ভরা ঘাস জন্মেছে। তবে গাছের গুঁড়িগুলোর চারপাশেই ওগুলো অনেক বেশি জন্মাত। ভেঙে-পড়া গাছের ডালগুলো শুকিয়ে এমন খটখটে হয়ে গিয়েছিল যে, পায়ের একটুখানি আঘাতেই মিহি কফির গুঁড়োর মতো ছড়িয়ে পড়ল। আর গাছ ফুটো-করা কীটের সুরভের আবরণ মুক্ত গোলক ধাঁধার রাস্তা কর্মব্যস্ততায় স্পন্দিত হলো। ডানাযুক্ত পিঁপড়ে আর সামরিক বাদ্য বাজিয়েদের মতো লাল ছোপওয়ালা পিঁপড়ে আর কালো কালো গুবরে পোকার দল এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিল।

একটু পরেই অলস বিশাল এক মাছি একটা গাছের গুঁড়ির নিচের চাক থেকে বেরিয়ে উড়োজাহাজের মতো গর্জন করতে করতে ওপরে উড়ে গেল। তার হুলটা বের করে রেখেছে, কোনো অনুপ্রবেশকারীর দেখা পেলে ফুটিয়ে দেবে তার কপালে।

আকাশে জমে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। যেন সেই মেঘের তুলোর গাদায় শুয়ে শুয়ে নিচের সুহৃদ আকাশটাকে দেখা যায় যেখানে আছে বন-জঙ্গল, কাটার যোগ্য হয়েছে এমন শস্য, বনবীথি, স্বচ্ছ জলের ধারা; চরে বেড়ানো গবাদি পশুর দল।

বনের ধারে একটা খেতের উপর পেলাম একগুচ্ছ চমৎকার নীলফুল। ওগুলো এমন যেন গোছা গোছা হয়ে ফুটেছে যে, মনে হচ্ছে নীল জলে ভরা গভীর হ্রদ। ফুলগুলোর বড় একটা গোছা তুলে নিলাম। গন্ধ নেওয়ার জন্য যখন নাকের কাছে নিলাম, শুকনো বিচিগুলো ঝরঝর করে পড়ে গেল। ঝুমঝুমির মতো শব্দ হলো। এরকম ফুল আগে কখনো দেখিনি। দেখতে অনেকটা ব্লুবেলের মতো। তফাৎ শুধু এই—ব্লুবেলগুলো মাথা নিচু করে রাখে আর এগুলোর মাথা ওপরের দিকে খাড়া হয়ে থাকে।

যে-রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম যেটি গিয়ে পড়েছে একটা খেতের ভেতর। লক্ষ্য করলাম, মাথার ওপর থেকে ভেসে আসছে লার্ক পাখির গান, গায়ক পাখি বলে ওদের সুনাম আছে। মনে হলো তারা যেন তারের কোনো যন্ত্র অলসভাবে বাজিয়ে চলেছে। তারটাকে একবার সামনে, একবার পেছনে টেনে আনছে। কখনো ফেলে দিচ্ছে, নিচে পড়ার আগেই ধরে ফেলছে, যাতে এর অপূর্ব সুরধ্বনি একবারের জন্যেও থেমে না যায়।

তখন সেই রাস্তা ধরে গ্রামের দুটো মেয়ে হেঁটে আসছিল আমার দিকে। নিশ্চয়ই তারা এমন জায়গা থেকে আসছিল যেখানে পানি-টানি কিছু আছে। তাদের ফিতেয় বাঁধা জুতোগুলো কাঁধের ওপরে ঝোলান। তারা গল্প করতে করতে হাঁটছিল আর হাসাহাসি করছিল কিছু একটা নিয়ে। আমাকে দেখা মাত্র থমকে দাঁড়াল। স্কার্ফে বাঁধা তাদের সুন্দর চুলগুলো তাড়াতাড়ি করে ঠিকঠাক করে নিয়ে বেশ সংযতভাবে ঠোঁট চেপে রইল।

কাউকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে রোদে পুড়ে যাওয়া, ধূসর চোখ আর হাসিখুশি দুটি মেয়ে হঠাৎ করে গম্ভীর হলে গেলে নির্ঘাত খারাপ লাগবে তার। তার চেয়েও খারাপ লাগবে যখন তার পাশ দিয়ে চলে যাবার পর তাদের হাসির শব্দ যদি তিনি পেছন থেকে শুনতে পান।

আমি যখন প্রায় রেগে যাচ্ছিলাম মেয়ে দুটি থেমে এমন সলজ্জ মিষ্টি হাসি দিল যে আমি একেবারে পুতভম্ভ হয়ে গেলাম। গ্রামের নির্জন রাস্তায় কোনো যুবতীর ঠোঁটের কোণে ঝলকে ওঠা হাসির মতো সুন্দর আর কিছু এই দুনিয়াতে নেই। চকিতে, ক্ষণকালের জন্যে তার নীল চোখের গভীর থেকে যে-ভালোবাসা ও স্নেহাসিক্ত আলো বিচ্ছুরিত হলো দেখে বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়—যেন একরাশ সুগন্ধ, সুরভিত পুষ্পলতা কিংবা হথর্নের ঝোপ হঠাৎ ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেছে ঠিক আপনার চোখের সামনে।

“আপনাকে অনেক-অনেক ধন্যবাদ” মেয়ে দুটো বলল।

“কিন্তু কেন?”

“এই ফুলগুলো হাতে করে আমাদের পথ দিয়ে যাবার জন্যে।”

হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল মেয়ে দুটি। দৌড়াতে-দৌড়াতেই পেছন ফিরে হাসিমুখে বলতে লাগল, “ধন্যবাদ, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

মনে-মনে ভাবলাম মেয়ে দুটি নির্ঘাত আমার সঙ্গে মজা করছে। হয়তো রাগাতেও চাইছে একটুখানি। তার পরেও আমার মনে হলো ওই ছোট্ট ঘটনাটিতে এমন এক রহস্য লুকিয়ে আছে যা বোঝার সাধ্য আমার ছিল না।

গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন পোশাকে সজ্জিত প্রাণবন্ত এক বৃদ্ধার দেখা পেলাম। ছাই-রঙা একটা ছাগলের গলায় রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আমার দিকে চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে গেলেন। একপা এগিয়ে হাত ওপরে তুললেন তারপর জোরে জোরে বললেন, “ওহে বাছা কী ‘সৌভাগ্য’ যে তুমি বয়ে নিয়ে যাচ্ছ, বলব কী আর তোমাকে! ধন্যবাদই বা জানাবো কোন ভাষায়?”

“এত ধন্যবাদ জানানোর কী হলো দাদি, কী এমন লম্বা-চওড়া কাজ আমি করেছি?”

সুন্দর করে মাথাটা নাড়িয়ে বুড়ি বললেন, “তুমি দেখছি ছোকরা বেশ চালাক। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না, কথা শুনে মনে হচ্ছে কিচ্ছুটি জানো অ্যা?

“যাই হোক, আমি তোমাকে বলতে পারবো না বাপু, নিয়ম নেই। যেখানে যাচ্ছ যাও, তবে তাড়াহুড়ো কোরো না, ধীরে-ধীরে যাও। যতো বেশি লোকের সঙ্গে তোমার দেখা হয় ততো ভালো।”

গ্রামে না-পৌঁছা অবধি এই রহস্যের কোনো কূল কিনারা হলো না। সবকিছু খোলাসা করলেন গ্রামের চেয়ারম্যান ইভান কারপোভিস তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। কারপোভিস সাহেব কড়া প্রকৃতির আর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। ঐতিহাসিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে গবেষণা করবার আগ্রহও আছে তার, যাকে তিনি স্থানীয় গবেষণায়, অর্থাৎ কিনা নিজ জেলা সম্পর্কে জানবার আগ্রহ বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, “আপনি একটা দুর্লভ ফুল খুঁজে পেয়েছেন। এই ফুলের নাম সৌভাগ্য-পুষ্প। জনশ্রুতি আছে—যদিও জানি না কথাটা আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে কিনা—এই ফুল মেয়েদের জন্যে বয়ে আনে সত্যিকার ভালোবাসা, বয়স্কদের জন্য শান্তিপূর্ণ বার্ধক্য, আর সবার জন্যে সুখ।”

একথা বলে সলজ্জ হাসলেন কারভোভিস। বললেন, “আমার সঙ্গে যখন আপনার দেখা তখন আপনার হাতে ছিল ওই জাদু-করা ফুল। তার মানে আমিও আমার কাজে সাফল্য লাভ করবো। আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে আমাদের গ্রাম পর্যন্ত যে-রাস্তাটা হয়তো এ বছরই তার নির্মাণকাজ শেষ করতে পারব। আর ঘরে তুলতে পারব এ বছরের প্রথম ফসল—ভুট্টা যা আগে কখনো ফলত না আমাদের এখানে।”

একটুখানি থামলেন তিনি, তারপর হেসে বললেন, “মেয়ে দুটির জন্যে খুশি লাগছে আমার। খুব ভালো মেয়ে ওরা। এ-অঞ্চলে ওরাই সবচেয়ে বেশি সবজি ফলায়।”

১৯৫৩