ঈদসংখ্যা ২০২২

পাঁচ দেশের ৫টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

পাঁচখানা নতুন পুত্র || জাকারিয়া তামের, সিরিয়া

বিরাট হইহল্লা আর শোরগোলের মধ্যদিয়ে আবদেল সাত্তার আর লায়লার বিবাহ সম্পন্ন হয়, যাতে অংশ নিয়েছিল মহল্লার ছেলেবুড়ো সবাই; কিন্তু বিবাহের হানিমুন পিরিয়ডের পুরোটুকু উদযাপন করা বেচারা আবদেলের ভাগ্যে ছিল না। বিয়ের ঠিক তিনদিনের মাথায় তাকে সাময়িকভাবে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, আর সেই সাময়িক গ্রেফতারের ফাঁড়া কেটে মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার লেগে যায় দশবছর। মুক্তির দিন, আবারো মহল্লার ছেলে-বুড়ো-বাচ্চা কিংবা রমণী, সবাই এসে ভিড় করে আবদেলের জন্যে, জেলখানার বাইরে। জেলগেট দিয়ে তার সুরতটুকু স্পষ্ট হয়েওঠা মাত্রই পরিচিত মহিলার তীক্ষ্ণ উচ্চকিত কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ছেলেরা বিকট শোরগোল আরম্ভ করে, আর পুরুষেরা আবদেলের দিকে ছুটে যায়, উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়, মুক্তির নিমিত্তে অন্তরের গহিন থেকে উঠে আসা কোমল সব বাক্যে তাকে অভিবাদন জানায়। আবদেল কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে সবাইকে ধন্যবাদ দেয়, চারপাশের হট্টগোলে যদিও তার কোনো কথাই শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু এই শোরগোল দ্রুতই থেমে যায়, যখন সবাই আবিষ্কার করে যে ভিড়ের মাঝে খুঁজতে খুঁজতে আবদেল তার দশবছর আগের নবপরিণীতা স্ত্রীকে অবশেষে পেয়ে গেছে। তার স্ত্রী, এবং স্ত্রীকে ঘিরে দাঁড়ানো পাঁচটি শিশু। সবকটাই ভিন্নভিন্ন বয়সের, এবং ভিন্নভিন্ন শারীরিক কাঠামোবিশিষ্ট। উদাহরণ–মোটা এবং চিকন, লম্বা এবং খাটো, ফর্সা এবং কালো, কালো চুলের এবং সোনালি চুলের। লায়লা তার পানে অপলক তাকিয়ে থাকা স্বামীকে আবিষ্কার করে একহাতে আনন্দাশ্রু মোছে, আর অন্য হাত নাড়িয়ে তার স্বামীকে অভিবাদন জানায়। দুরুদুরু বুকে আবদেল এগিয়ে যায় তার স্ত্রীর দিকে; দুই হাতে আঁকড়ে ধরে চোখের পানি মোছায় ব্যস্ত লায়লার ছোট্ট, নরম হাতখানা, যেমন করে পানিতে ডুবন্ত কোনো ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য তার হাত আঁকড়ে ধরে কেউ।

আবদেল সাত্তার অবাক হয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তার সৌন্দর্য এবং তারুণ্য বৃদ্ধি পেয়েছে আরও কয়েকগুণ। শুধু তাই নয়, লায়লাকে তার বয়সের অনুপাতে অনেক ছোটও লাগছে। পাড়া-মহল্লার লোকজন চেঁচিয়ে উঠলে আবদেল হেসে উঠে বলে, ‘ও তো আমার আইনত স্ত্রী। ভুলে গেছ সবাই, খোদা আর তার রাসুলের আইন অনুযায়ী ওকে বিয়ে করেছিলাম যে আমি?’

হইহল্লা আর হাসির আওয়াজ একত্রে মিলেমিশে যায়, তারা আবদেল আর লায়লার পিছুপিছু তাদের বাড়ির দিকে রওনা হয়। বাড়ি পৌঁছে আবদেল তাদের উঠানে তিতা কমলায় ভর্তি গাছের ছায়ায় আয়েস করে বসে কফিতে চুমুক দেয়। হঠাৎ করেই সে তার তর্জনী নিবদ্ধ করে পাঁচটি শিশুর প্রতি, যারা প্রত্যেকেই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হয় লজ্জাবনত, অথবা উগ্রচোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওরা কারা? আমাদের প্রতিবেশীদের বাচ্চা ওরা, নাকি আমাদের কোনো আত্মীয়ের?’―আবদেল প্রশ্ন করে।

আবদেলের বৌ সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিবেশীদের পৌরুষ ও দায়িত্ববোধের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে থাকে। পরিবার হারিয়ে একাকী এক রমণীর যা কিছু দরকার, তারা তার সবকিছুর যথাযথ ব্যবস্থা করেছে সবসময়। আবদেল তাকে সে প্রশংসাযজ্ঞের মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে, বাচ্চাগুলো কার। এইবারে তার বৌ তার দিকে অবিশ্বাস, এবং বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকায়। ‘অদ্ভুত প্রশ্ন!’ সে বলে। ‘বোকা ব্যাটামানুষ, নিজের সন্তানদের নিজেই চিনতে পারছ না? জেলে গেলে মানুষের স্মৃতিভ্রংশ হয়―এ তো দেখি বড় সত্য কথা!’ আবদেল সাত্তার বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করে, ‘যখন আমি জেলে গিয়েছিলাম, তখন কি তুমি গর্ভবতী ছিলে?’

‘না,’ লায়লা উত্তর দেয়, ‘ছিলাম না তখন গর্ভবতী। কি লজ্জার বিষয়! আমাদের বিয়ের বয়স ছিল তখন তিনদিন মাত্র। আমাদের মধ্যে লাজের আড়ই তো ভেঙে সারেনি তখন।’

লায়লা একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘সে যাই হোক, আমাদের মহল্লার মতো মহল্লা হয় না। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সায়ীদ সাহেবের কথা মনে আছে তোমার?’ উনিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের প্রথম সন্তানটা উপহার দিলেন। আহা, মানুষ হয় না ওনার মতন! কি কষ্টটাই না তিনি করলেন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে!’

‘আর দ্বিতীয়জন?’ আবদেল সাত্তার প্রশ্ন করে।

‘ভালো করে খেয়াল করো,’ লায়লা বলে, ‘তাহলে এখনই তুমি বলতে পারবে, ওর জন্মের পিছে কার হাত আছে। পুরো মহল্লায় সোনালি চুলের মানুষ আছে একজনই, সম্মানিত আবদেল হাফিজ সাহেব। ঘরে দুই দুইখানা ব্যাটাখেকো বৌ থাকার পরেও তিনি আমাকে সাহায্য করেন ওর জন্মে।’

‘আর তৃতীয়জন?’ আবদেল সাত্তার আবারো প্রশ্ন করে।

‘তুমি ওনাকেও চেনো।’ লায়লা উত্তর দেয়, ‘এবং এই সন্তানের জন্মদাতা বাছাইয়ে আমার রুচির তারিফ করবে তুমি সহানুভূতিশীল আদর্শিক এক মানুষ, রোজা রাখা, হজ্ব করা থেকে নিয়ে দিনে পাঁচওয়াক্ত আজান পড়া মাত্র নামাজে নেতৃত্ব দেন যিনি। আশা রাখি আমাদের এই পুত্রসন্তান তার কিছু কিছু গুণ পাবে।’

‘চতুর্থটা?’ আবদেল সাত্তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

‘ওর জন্ম হয়েছে আমার ডাক্তারের কৃপায়, আমি মোটামুটি নিশ্চিত।’ লায়লা উত্তর দেয়। ‘আমার ঔষধপথ্য, আর বাচ্চাকাচ্চা মুক্তভাবে বড় হবার ব্যাপারে বড় এহসান করেছেন উনি।’

‘পঞ্চমজন?’ আবদেল প্রশ্ন করতেই থাকে।

‘যেহেতু তুমি আর আমি, দুজনেই মিথ্যা বলা একদম পছন্দ করি না, সেহেতু আমি সত্যই বলব।’ লায়লা বলে। ‘আমি আসলে ভুলে গেছি ওর আসল জন্মদাতা কে। তালগাছের মতো লম্বা আর আমাদের ঘরের এই দরজার মতন চওড়া দশজন, বা তারও বেশি সংখ্যক মানুষের সকলের, বা তাদের মধ্যেই কারুর কৃতিত্বের ফসল ও।’

আবদেল সাত্তারের হাতের আঙুলগুলো হঠাৎ করেই কফির কাপের ভার বহন করতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সে কাপ তার হাত থেকে নিচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় মুহূর্তের মাঝে। রুখু কালো পাথরের দেয়ালে সে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে মনে চায়, যেমন কান্না সে কেঁদেছে নিয়মিত, জেলে থাকা অবস্থায় যখন তাকে কুত্তাপেটা করা হতো―সেসব দিনে। কিন্তু, কেন যেন তার চোখ শুষ্কই রয়ে গেল।

(ইব্রাহীম মুয়াবির করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ)


পৃথিবীর শেষপ্রান্তে অবস্থিত একটি ভেন্ডিং মেশিন || জোসেফিন রোই, অস্ট্রেলিয়া

ও আমার নামে নাম, এমন একটা হোটেলে উঠে পড়ে, আর বেশিরভাগ রাতে পয়সা দিয়ে ফোন করা যায়, হলওয়ের এমন এক ফোনবুথ থেকে আমায় ফোন দেয়। এর আগে ও আমাকে সেকেন্ড এভিনিউ, আর পাইনগাছের কোনাতে যে ফোনবক্সটা আছে, সেখান থেকে ফোন দিত। পেছনে বাজত সাইরেনের আওয়াজ, শুঁড়িফেরত মাতালদের চিৎকার―'মারা খা মাদারচোদেরা, এই দেখ আমি উড়তে পারি!' সেসময় ও রাতে পার্কে ঘুমোত, আর দিনেরবেলা টেলিফোনে সিয়াটল অপেরার টিকেট বিক্রি করত। এই করে যা কিছু উপার্জন হতো, তার সবটা ও খরচ করত বিয়ারের বোতল, আর ইন্টারন্যাশনাল ফোনকার্ডের পিছে। তার পরপরই ও বিয়ার খাওয়া কমিয়ে দেয়, আর আমার নামের সঙ্গে মেলে, এমন নামের এক হোটেলে এসে উঠে পড়ে। এই ধরনের ভালোবাসা আমার খুব ভীতিকর মনে হয়। যে ভালোবাসা মানুষের বিয়ার পানের অভ্যাস কমিয়ে দেয়, আর স্রেফ নামের মিলের কারণে হুটহাট একটা হোটেলে উঠে পড়তে বাধ্য করে।

যখন ও আমায় কল করে, তখন আমার এখানে প্রায় মধ্যরাত, আর ওর ওখানে ভোরবেলা। যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, সে বাড়ির এক ময়লা ধূসর কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আমি কথা বলি। ফোনের লম্বা তার টেনে আনা লাগে অনেকদূর, যাতে সম্মুখের তারজালির ফোঁকর গলে আমার ধূমপানটা চলতে পারে। আমি মনে মনে ওকে কল্পনা করি। কানে ফোনটা ধরে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছে ও, পেছনের হলওয়েতে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে কারা যাচ্ছে―আসছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছাড়া। আমার কল্পনায় ওকে এখনও খানিকটা উদ্বাস্তুই লাগে : জন এফ কেনেডি একবার থেকেছিল এই হোটেলে, ও আমায় বলে, এলভিস প্রিসলিও। কিন্তু এখন কাঁচিগেটওয়ালা এলিভেটরটা সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার সারাই করা লাগে, এদিকে যে কামরার রুম টেম্পারেচারে রাখা ফর্টিস বিয়ারের কিছু বোতল, আর একটা চুরি করা ডেস্ক নিয়ে ওর আবাস, তা ঠিক চৌদ্দ সিঁড়ি ওপরে।

ওর আলাপের দুটো প্রিয় বিষয়বস্তু হচ্ছে―লেসার প্রেইরি মুরগি, আর ফ্রিমন্ট এলাকার একটা জনশূন্য ব্লকের ঠিক মাঝ বরাবর রাখা একটি ভেন্ডিং মেশিন। ভেন্ডিং মেশিনটার একেকটা বাটন টিপলে একেকরকমের পানীয় বের হয়। তবে তার একটা বাটন আছে, যাতে কোনো লেবেল লাগানো নেই। কাজেই বোঝা সম্ভব হয় না যে ওটা টিপলে কি বেরুবে। এই রহস্যপূর্ণ বাটন ঘিরে ওর ম্যালা চিন্তাভাবনা। কোন ধরনের সোডা বেরুবে, ওটা টিপলে? ‘ট্যাব’, নাকি ‘মিস্টার পিব’? ও ওর ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত নানা সোডা ব্র্যান্ডের নাম আওড়াতে থাকে, যার অধিকাংশ এখন আর বাজারে নেই-ই। এদিকে আমি ওর আলাপে তাল মেলাতে পারি না, কারণ ওর শৈশব ছিল আমার শৈশবের এগারো বছর আগে, তাও দুনিয়ার আরেক প্রান্তে।

‘ট্যাব’ বেরুবে নিশ্চিত, ঐ সুইচ টিপলে, ও অবশেষে চূড়ান্ত মতামত জানায়। ভেন্ডিং মেশিনটাকে ও একটা টাইম ট্র্যাভেল মেশিনে পরিণত করে ছেড়েছে। ট্যাব বিয়ার হাতে কাটানো গ্রীষ্মের দিনগুলিতে ও ফেরত যেতে চায়। ফিরতে চায় ১৯৮২ সালের আটলান্টা, জর্জিয়ায়; যখন ওর মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে জেলহাজতে ঢোকা, বা মেক্সিকোর রিহ্যাবে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। ও ওর চাচার ফার্মে ফেরত যেতে চায়, যেখানে ও মনের সুখে লেসার প্রেইরি মুরগি পালবে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই পারলে ও মনে মনে চলে যায়, শুধু অপেরার টিকিট বিক্রি করে জীবন কাটানো সিয়াটল শহরটা ছাড়া, যা ওর বর্তমান আবাস।

একরাতে ও আমাকে ফোন করে জানায় যে সে এরমধ্যে ফ্রিমন্ট গিয়েছিল। সে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে অবস্থিত ভেন্ডিং মেশিনটার লেবেল ছাড়া রহস্যপূর্ণ বাটনটা চেপে দেখেছে।

জানো, কি পেলাম ঐ সুইচ টিপে?

কি পেলে? আমি প্রশ্ন করলাম।

বালের স্প্রাইট!

এভাবে, আস্তে আস্তে ১৯৮২ সালের আটলান্টা, জর্জিয়া মিলিয়ে গেল আমাদের কল্পনার জগৎ থেকে। একইসঙ্গে আমাদের আলাপের বিষয়বস্তুও কমে গেল আরেকটা।


অতীত || হুয়ান কার্লোস বোতেরো, কলাম্বিয়া

ঘুম ভেঙে গেল তার : মিহি কান্নার আওয়াজ অবশেষে তার ঘুমের বর্ম ভেদ করে প্রবেশ করল কর্ণকুহরে। ঘোলা চোখে তাকাল সে চারপাশে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে রাতের আকাশে চাপা আলো দেখা যায়। শীঘ্রই ভোর হবে, ভাবে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে ও উপলব্ধি করে, তার সঙ্গিনী কান্না করছে। মেয়েটার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সে তাকায় তার দিকে। ‘কি হয়েছে?’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে প্রশ্ন করে সে। আধো আলো আধো ছায়ার মাঝে মেয়েটার তিরতির করে কাঁপতে থাকা নগ্ন পিঠের ওপর নিজের হাত রাখতে সক্ষম হয় সে। বেডশিট মেয়েটার কোমর পর্যন্ত জড়ানো। স্বস্তি পৌঁছানোর জন্যে সে আস্তে আস্তে মেয়েটার কাঁধজুড়ে চাপ দিতে থাকে। ‘আরে হয়েছেটা কি?’ মেয়েটা এবারে খানিকটা ধাতস্থ হয়। সে বিছানার ওপর পা আড়াআড়ি করে বসে, বেডশিটের কোনা দিয়ে চোখ মোছে। বেশ কিছুক্ষণ সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে মেয়েটি নিজেকে বয়ে বেড়ানো কষ্টের ভার থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে আমি অন্য কাউকে ডেট করছি’ সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে, ‘আমার বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ এইটুকু মাত্র বলে মেয়েটা আবারো অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে। চিৎকার করে কান্নার সঙ্গে টেনে টেনে নিজের চুল ছেঁড়ার উপক্রম করে সে― ‘ভয়াবহ লাগছে, খুব খারাপ লাগছে আমার!’ ছেলেটা স্থব্ধ, শীতল। বিস্ময়াভিভূত চোখে সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটির মনে এখন ঠিক কি অনুভূতির স্রোত বয়ে চলছে, সেটা ধরা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তারপর, হঠাৎ করেই যেন স্মৃতির পাতা থেকে উঠে এসে তাদের অতীত, ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। অনেকগুলো ঘটনা, বায়স্কোপের দুর্বোধ্য, দুর্মর ছবিগুলোর মতো একের পর এক সাঁইসাঁই করে ছুটে চলে তার স্মৃতির পর্দায়। মায়ের কাছে বেড়াতে যাওয়া, কাজের চাপে সপ্তাহান্তগুলো একসঙ্গে না কাটানো, অফিস থেকে প্রায়ই দেরি করে ফেরা, প্রায়প্রায়ই ফোন আসা―আর রংনম্বর বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, এ সমস্ত ঘটনা তাদের নিষ্কলুষতার খোলস ছেড়ে নতুন অর্থ নিয়ে প্রতিভাত হয় তার সামনে। একদা নিষ্পাপ এমন প্রতিটি ঘটনাই তার চোখে বিশ্বাসভঙ্গের অনিবার্য চিহ্ন হয়ে ফুটে ওঠে। সে অনুভব করে, তার মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠ অপরিচিত এক নতুন অতীতের স্মৃতিতে ভরে উঠছে। তার অন্তরকে প্রবল যন্ত্রণা খুঁচিয়ে চলে ক্রমাগত, এবং তা টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার আগে এই উপলব্ধিতে পৌঁছায় যে, ‘অতীত’ আসলে সময়ের খাপে পোরা জমাটবদ্ধ, অপরিবর্তনীয় কোনো স্মৃতিপথ নয়, যেমনটা সে সবসময় ভেবে এসেছে। বরং তার উল্টোটা। অতীত হচ্ছে নমনীয়, কাঁপা কাঁপা, ভঙ্গুর এক স্মৃতিপথ। দু-একটা বাক্য, খুব সহজে যার আমূল বদলে দিতে পারে।


সবারই ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস করতে হয় || কুঝালি মানিকাভেল, ভারত

সমুদ্রের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, দুরাই আর আমি ঘুরে বসে হাইওয়েতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। দুরাই বলেছিল, বেশিক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমরা অন্ধ হয়ে যাব। অপরদিকে হাইওয়ের পানে ঠায় চেয়ে বসে থাকা হয়তো আমাদের কিছুটা দুঃখী দুঃখী করে তুলবে, বড়োজোর আমরা ঘুমিয়ে পড়ব। রাস্তায় মরে চ্যাপ্টা হয়ে থাকা কিছু একটা বস্তুর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে খানিক আলোচনা করবার। ‘একেবারে শুরু থেকে আমাদের জার্নিটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করি চলো,’ দুরাই বলে।

‘আমরা এখানে এসে পৌঁছলাম কীভাবে?’

দুরাই-ই প্রথমে মুখ খোলে। সে বলে যে, ছোট বয়সে তার ভক্তিমূলক গান গাওয়ার অভ্যাস ছিল। ‘ঈশ্বর’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ আপনাতেই বুঝে আসত।

‘নতুন কিছু গাও,’ আমি বললাম। ‘যেকোনো কিছু।’

‘না।’

‘আরে ধুরু! খোদাকে নিয়েই গাইতে হবে, এমন না। অল্প একটু গেয়ে শোনাও। একলাইন।’

দুরাই দুহাত দিয়ে তার মুখখানা ডলাডলি করল খানিক, ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সমুদ্রের দিকে আরেকবার। তারপর মিহিন স্বরে তামিল ভাষায় গাইতে শুরু করল। ‘শুধুই এক পুতুল তুমি, আমিও শুধুই পুতুল এক, ভাবলে পরে বুঝতে পারবে, আমরা সবাই পুতুল এক।’

এই ফাঁকে দেখলাম, সারিবদ্ধ উকুনের ডিম, পুঁতির মতন জ্বলজ্বল করছে ওর চুলে।

‘কেমন লাগলো?’ দুরাই প্রশ্ন করে।

‘গাওয়ার মতো আর কোনো গান ছিল না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তারপর, আমি দুরাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, কেন ও আর গান গায় না।

‘কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে তোমার,’ আমি বললাম। ‘কেউ নিশ্চয়ই তোমাকে মিউজিক্যালি অ্যাবিউজ করেছে, ক্ষতি করেছে তোমার সঙ্গীতপ্রতিভার।’

‘ঠিক আছে, এবারে তোমার পালা। কি করার কারণে তোমার এখানে আসা লেগেছে?’

‘কিছুই না।’

‘ভেবে চিন্তে বলো। কিছু তো নিশ্চয়ই করেছিলে।’

‘ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস।’

‘ওটা ধর্তব্য নয়। সবারই ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস করতে হয়।’

‘সবার করা লাগে না। গরিবরা করে না।’

‘গরিবদেরও করা লাগে। যদি গরিব ফ্যামিলির কেউ স্কুলে যায়, তারও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস করতে হয়।’

দুরাই যখন আরেকদিকে তাকিয়েছিল, আমার মন চাইছিল ওর চুল থেকে একটা উকুন তুলে আনতে। চিন্তা করছিলাম, ধরা পড়ার পর, আমার হাতের তালুতে আটক ছোট্ট, বিকৃত আকৃতির একটি তারার মতো সে উকুন কি মোচড়ামুচড়িটাই না করবে।

দুরাই বলল, আমাদের আলোচনা আসলে কোনদিকে এগুচ্ছে না। তারপর ও নিজেই পরামর্শ দিলো, নিজ নিজ জীবনের গোপন সব ঘটনা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা যাক।

‘ঠিক আছে, তুমি শুরু করো,’ বললাম আমি।

‘কলেজে থাকতে আমি জেলে গিয়েছিলাম।’

‘তো?’

‘তো, মানে? জেল মানে জেল। আসল জেল। যেখানে থাকে লোহার গরাদ, আর দুর্গন্ধময় টাট্টিখানা।’

‘কলেজে থাকতে সব বেটামানুষই জেলে যায়। নেশা করে, বেশ্যাদের প্রেমে পড়ে।’

‘ওহ মোটরসাইকেলের কথা তো ভুলেই গেছি। আমাদের সবার মোটরসাইকেলও থাকে ঐ বয়সে।’

‘যখন আমি ছোট ছিলাম, আমি না ছেলে হতে চাইতাম। ভাবতাম, ভালো হতো যদি আমার নাম সাথিয়া হতো, মাথায় হ্যাট আর চোখে সানগ্লাস পড়ে ঘুরে বেড়াতাম।’

দুরাই ওর হাতের কবজির উল্টোপাশে নখ দিয়ে আস্তে আস্তে সোজাসুজি দাগ টানতে লাগল, যেন ভেতর থেকে অন্তত একটা রগ কেটে বের করে আনা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে ওর।

‘তোমার এখনও ছেলে হবার খাহেশ আছে?’ প্রশ্ন করল ও।

‘না। একবার বুক উঁচু হওয়া শুরু করবার পর আমি আমার মন বদলে ফেলেছি।’

‘ভালো। আমার পছন্দ, তোমার বুবস।’

‘তা আর বলতে।’

আমরা তখনও রাস্তামুখী হয়েই বসে ছিলাম, কিন্তু আমাদের ঘাড় ছিল ঘোরানো, এবং আমরা আবারো সমুদ্র দেখছিলাম। এরই মধ্যে আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি যে, স্কুলের রসায়ন ল্যাব থেকে আমরা দুজনেই ছেলেবেলায় মার্কারি চুরি করেছি। দুরাই ওটা ওর পকেটে লুকিয়ে রেখেছিল, আমি আমারটা জ্যামিতি বক্সে। শুধু তাই না, আমরা দুজনেই ঐ বস্তু নিজেদের হাতে মুখে ঘষেছি বেশ করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এতে করে আমাদের ক্যান্সার হবে, কিন্তু দুরাই বলল এর ফলে বেশির চে বেশি আমরা খানিকটা পাগলা হয়ে যেতে পারি। আমি পেছনে হেলান দিয়ে বসে দুরাই এর মাথায় রক্ত চুষতে থাকা, আর ধামাধাম লাগিয়ে বেড়ানো উকুন নিয়ে আবারো ভাবতে লাগলাম।

‘আমার ঘাড়ব্যথা করছে। আমরা সমুদ্রমুখী হয়ে বসলে কি হয়?’ আমি বললাম।

‘উঁহু, খুব জলদি হয়ে যাবে ব্যাপারটা।’

‘কি যেন গানটা? জলদি আসা, বা জলদি ঘটা নিয়ে? ডিস্টিং ডিস্টিং সামথিং সামথিং?’

‘জানি নারে বাবা,’ দুরাই বলে।

‘নিশ্চিত তুমি? আমি তো ভেবেছিলাম সবাই জানে ঐ গানটা।’

আমি হাই তুলতে তুলতে দেখি এক ধুমশে কালো উকুন ওর চুল বেয়ে ক্রমশ উপরে উঠে এসে আকাশের দিকে পাগুলো তুলে ধরে প্রাণান্তকরভাবে কিলবিলিয়ে চলছে।


ছোটমেয়েরা || তারা লাস্কওয়াস্কি, যুক্তরাষ্ট্র

জেন তারে কাপড় মেলবার সময় তার বাবা কল করে, ফোনের ওপাশ থেকে তার কণ্ঠস্বর কেটে কেটে আসে। এক পেশাদার ভায়োলিনবাদক মহিলাকে নিয়ে এক ঘটনা শুনেছে সে। পা পিছলে সে এক খোলা ডিশওয়াসারের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ছুরির উন্মুক্ত ফলায় হাত পড়ে তার হাত কেটে হাঁ হয়ে গেছে। সে হয়তো আর কখনো ভায়োলিন বাজাতে পারবে না।

কাঁধ আর কানের মাঝে ফোনটাকে ঠেসে ধরে জেন তার বাবার কথা শুনতে থাকে, তার আঙুলের ডগায় তখন কাপড় আটকাবার ক্লিপগুলো। হঠাৎ একখানা ক্লিপ ছুটে গড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশীর বেড়ার ঢাল বেয়ে। কেউ ওটাকে তুলে আনার আগ পর্যন্ত ওখানেই ওর ঝুলে থাকতে হবে। জুন মাসের হিসাবে বাতাসে আদ্রতা তুলনামূলক অনেক বেশি, জেনের খালি পায়ের নিচের ঘাসগুলোকে খড়ের মতো খসখসে লাগে।

‘আমি চাই যে তুমি নিজের আরও যত্ন নাও, জেনি,’ তার বাবা বলে একথা। জেনের কল্পনায় তার বাবার প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে―হাইওয়েতে নিজের কারে বসা, হুহু গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে বেড়াচ্ছেন, গাড়ির গ্লাস নামানো, ঠোঁটের কোনে জ্বলছে ধূম্রশলাকা। এই লোকটাই তাকে বলছে জীবন বিপদে ভরা, সবখানে, যেকোনো জায়গায়। ‘ছুরি আর অন্যান্য ধারালো যন্ত্রপাতি থেকে সাবধানে থেকো।’

জ্যাকহ্যামারের ওপর পড়ে গিয়ে কাঁপতে থাকা তার শরীরের কথা ভেবে মনে মনে ভেবে জেন হাসে। উপরের কামরায় তৈরি হতে থাকা নার্সারি, যা তার স্বামী হালকা সবুজ রঙে কালার করছে, সেই নার্সারিতে সে খালিহাতে টেনে নিয়ে চলছে যেন এক ভারী চেইন স'। ইদানীং প্রায়ই জ্বালাচ্ছে, এমন এক প্রগাঢ় ঘুমঘুম পরিস্থিতিতে এসে হানা দিলে, আক্রান্ত সে আরেকটু হলে হাতের ফোনটা প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল। ‘রাখি তাহলে এখন,’ সে তার বাবাকে বলে। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ে সে খানিকটা বিরতি নেয়। পেটের ওপর আঙুল দিয়ে চাপ দেয় মৃদু।

একটা মেয়ে, সে ভাবে। হতে পারে সে খুব বিখ্যাত যে কেউ―একজন ডক্টর, একজন লেখক, অথবা ঐ ভায়োলিন বাদকের মতো মিউজিশিয়ান। সেই ভায়োলিনবাদক মেয়েটি কিন্তু ধরে নিয়েছিল যে সে তার রান্নাঘরে নিরাপদ আছে। একটু আগেই সে হয়তো মুরগির কোনো সুস্বাদু ডিশ দিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার ফাঁকে পরবর্তী কনসার্টের বুকিং দিচ্ছিল। তারপরই হয়তো পায়ের নিচ দিয়ে এক বিড়ালের আচমকা দৌড়, পা পিছলে যাওয়া। তারপর রক্ত, অনেক অনেক রক্ত। তার বাবা-মা কি কখনো তাকে এটা শেখায়নি যে, ছুরির ফলা ওপর দিকে রেখে ছুরি কখনো ডিশ ওয়াসারে প্লেস করতে হয় না? কেউ না কেউ অবশ্যই এটা বলেছে তাকে। মানুষের তো এই এক স্বভাব, ফাউফাউ চুইংগামের মতো করে ক্রমাগত ফাউ জ্ঞান বিলিয়ে বেড়ানো।

এরমধ্যে তার স্বামী তাকে পেছনের বারান্দা থেকে ডাকে। সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সে হাত তুলে চোখদুটোকে আড়াল করে। এদিকে তার স্বামী ভুল করে ভাবে যে, জেন বোধ হয় তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। জেন তার চোখের সামনে পাহাড়টা দেখতে পায়, যেন প্রথমবারের মতো, খুব খুব খাড়া সেটা। বেশ কয়েক বছর আগে জায়গাটা কেনার আগে এই ঝামেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক আলাপ হয়েছিল জেন আর তার স্বামীর। তার স্বামী তখন বলেছিল যে ঠিক এটার পাদদেশে তারা সুইমিংপুল বানাবে। জায়গাটা সহজে ঠিকঠাক ঘুরে বেড়ানোর সুবিধার্থে এখানে ওখানে কিছু চিহ্ন যুক্ত করবে। জেন তার স্বামীর দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া মাত্রই ঘোড়ার লেজে তৈরি তারের মতো করে তার পাজোড়া কাঁপতে থাকে। পড়বার আগেই সে মোটামুটি উপলব্ধি করতে পারে যে সে পড়ে গেছে―খুরের মতো তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট ঘাসগুলো ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে তার ভেতরে, তার ওজনে চাপা পড়ে বেঁকে না গিয়ে ছুরির ফলার মতো কোপ দিচ্ছে ক্রমাগত জেনের ওপর। ঠিক এসময় তার স্বামী দূর থেকে হাত নাড়িয়ে চলে, হাসে, হয়তো ভাবতে থাকে আবছা সবুজ প্রকৃতির মাঝে শান্ত সমাহিত কোনো ঘুমপাড়ানি গান নিয়ে।