ঈদসংখ্যা ২০২৩

শত্রুপক্ষের কণ্ঠ ও অন্যান্য

শত্রুপক্ষের কণ্ঠ ।। হুয়ান ভিল্লোরো

পৃথিবীর বুকে মেক্সিকো সিটি বলতে একটা জায়গা ছিল তখনও, আর আমি সে দিনগুলোতে সুন্দর এক হলুদ হেলমেট পরতাম। একটা পোলের চূড়ায় বসে মানুষের টেলিফোন আলাপে আড়িপাতা ছিল আমার কাজ। আকাশ বলতে ছিল বৈদ্যুতিক তারে জড়ানো এক সকাল; নরম প্লাস্টিকে মোড়ানো তারে বিদ্যুৎ প্রবাহ কেঁপে কেঁপে অগ্রসর হতো। কিছু সময় পর পর ঘন নীল স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়তো রাস্তার ওপরে। ঐ মুহূর্তটুকুই ছিল আমার পোলের ওপর চড়ে বসে থাকার সার্থকতা। কোমরের বেল্টে ঝুলে থাকতো হরেক কিসিমের যন্ত্রপাতি। কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল পাখির ঠোঁটের গড়নের একটা প্লায়ার্স। যন্ত্রটার দু'ঠোঁটের কামড়ে তারের গায়ে সমস্ত ক্ষত সারাই হয়ে যেতো। তড়িৎপ্রবাহ আবারো ছোটা শুরু করতো অনবরত।

আমার পোলের সামনে ছিল একটা মুভি থিয়েটার। তার তাঁবুর মাথায় কার্ডবোর্ডের তৈরি একটা প্রাসাদের সাইন লাগানো ছিল। আর পেছনে ছিল একটা দালান, যা অনবরত লালবাতি জ্বালাতে থাকতো, উড়োজাহাজের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেলেও আকাশের ঘন বায়ুর আস্তর এড়িয়ে ওদের দেখা যেতো না।

আমাদের বৈদ্যুতিক সুপারভাইজারের সাফ কথা, তারের ওপর একদম কান খাড়া করে বসে থাকতে হবে। তারবার্তার মাধ্যমেই শত্রুপক্ষ আক্রমণ শানাবে আমাদের ওপর। আমি জানতাম না যে কারা এই শত্রুপক্ষ, স্রেফ জানতাম যে তাদের আগমন অবশ্যম্ভাবী : কাজেই ফোনালাপে আড়িপাতা জরুরি ছিল, প্রয়োজনীয় ছিল যেকোনো সন্দেহজনক ঘটনাকে আমলে নেয়া। এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলবেলা, পোলের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে আমি এক অপরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম। কোন এক নারী, যেন নিজেকে লুকোনোর জন্য চাপাস্বরে শব্দোচ্চারণ করছিল; ত্রস্ত-মোলায়েম কণ্ঠে সে বলেছিল, ‘পাখির বীজ,’ ‘ঔজ্জ্বল্য’, ‘ম্যাগনোলিয়া’, ‘ভাঙা বারান্দা’। সব ধরনের কথোপকথনেই আড়ি পাতা, আর সবকিছু ঠিকঠাক আছে–এ নিশ্চয়তা দেয়া–এই ছিল আমার কাজ। অর্থহীন সংকেতের মতো মেয়েটার উচ্চারিত শব্দগুলো আমার কানে আঘাত করলো। আমার উচিত ছিল ব্যাপারটা উপরমহলে জানানো। কিন্তু আমি তা করলাম না; অপরপ্রান্তে যে বা যারা আছে তাদেরকেও এটা বোঝার সুযোগ করে দিলাম যে–আমি কী বুঝিনি।

অল্প কিছুদিন বাদে আগুনে ঝলসানো তালগাছের খবরটা আমার কানে এলো। অরণ্যানীতে ঢাকা আমাদের এক এলাকা শত্রুপক্ষ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমার জন্য নির্দিষ্ট করা পোলে ঝুলে থেকে আমি ঠাহর করতে পারছিলাম না যে এ শহর আয়তনে বাড়ছে, না আরও সংকুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ। ট্রাম্পেট আর বিউগলের সুউচ্চ আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো অনুগত সৈন্যবাহিনীর আন্তঃফোনালাপ। তারপর হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসতো, ভেসে আসতো মিলিশিয়াদের কর্কশ কণ্ঠ।

আমার উল্টোদিকের এক কোণার পোলে একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা চোখে পড়লো আমার; ওখানকার হলুদ হেলমেটটা বেশ কয়েক ঘণ্টা যাবত নড়াচড়া করছিল না। আমার এক সহকর্মী মারা গেছে, খবরটা আমি কাউকে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম; অনেকানেক ব্যস্ত নম্বরে ডায়াল করতে করতে আমার আঙুল ফেটে রক্ত বেরোবার জোগাড় হল। ঐ স্থির হেলমেটটার দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় সেই কোমল ও ভীতিকর শব্দগুলো আমি পুনরায় শুনতে পেলাম : ‘শয়নকক্ষ,’ ‘দারুচিনি,’ ‘ভাস্কর্য’। অসূয়াক্রান্ত অবস্থায় আমি কল্পনা করলাম, ঐ শব্দগুলো অন্য কারো জন্য সাংকেতিক অর্থবহন করছে। আমার জন্য শব্দগুলো কেবল দুঃখবাহী। এবারেও আমি আমার বৈদ্যুতিক সুপারভাইজারকে কিছুই জানালাম না।

একদিন সকাল বেলা আমি সচকিত হয়ে উঠলাম এক প্রকাণ্ড বিস্ফোরণের প্রকম্পনে। আমি তখন তার সারাই করার ওয়্যারিং বক্স খুলে বসেছিলাম ফটোইলেকট্রিক সেন্সরগুলো দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। আমি আমার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালাম, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে জ্বলবে এমন ব্যাটারি ওর মধ্যে পোরা ছিল, কিন্তু আমার মন বলল–তথ্যটা প্রাসঙ্গিক নয়, কেননা এ পোলটা টিকবে না অতক্ষণ।

ফোনে কথোপকথনের সময় আমাদের সুপারভাইজার বারবার বলতেন, ‘দূরালাপনির তার যাদের নিয়ন্ত্রণে, শহরের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতের মুঠোয়।’ আমাদের শত্রুপক্ষ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, মুভি থিয়েটার পুড়ে গিয়ে লালচে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হয়ে আছে মাথার ওপর, তবে ফোনগুলো তখনও কাজ করছিল। আমি সেই নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম আবার, ‘সুঘ্রাণ,’ ‘গ্রহসমুহ,’ ‘ক্যান্ডি,’ ‘মসৃণ পাথর’। এবারো আমি তার ব্যাপারে কোনো রিপোর্ট করতে পারলাম না। খুব ধীরে, ভীতিকর ও সুনির্দিষ্ট নির্মমতার সঙ্গে, আমি উপলব্ধি করলাম আমার শত্রুপক্ষের কণ্ঠ কতটা চিত্তাকর্ষক।

আমার সহকর্মীকে উল্টোপাশের পোস্ট থেকে নামিয়ে নেয়ার সময় আমি ঘুমাচ্ছিলাম সম্ভবত। আমার পালা এলে দস্তানায় মোড়া একটি হাত আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরল। অতোটা দূষিত বায়ু নাক মুখ দিয়ে শরীরে ঢোকায় আমার চেতনা ততক্ষণে লুপ্ত হয়েছে, এবং আমার কোন ধারণা নেই যে আমি ঐ পোড়া শহর থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসেছিলাম।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বা মাসের পর মাস ধরে আমি চারপাশে লোহার দেয়ালে আবৃত একটি কক্ষে বসবাস করছি। তারা প্রায়ই আমাকে কম্পিউটারে এক ভয়াবহ ছবি দেখায়। ছবিটার নাম প্রাসাদের শহর, এবং এতে দেখা যায় মাথার ওপর কাপ বোর্ডের প্রাসাদওয়ালা সেই মুভি থিয়েটারটা, পেছনের সে উঁচু দালান, এবং সেই তারগুলো—যার দায়িত্বে ছিলাম আমি। "সংখ্যায় সাতষট্টিটা," আমাকে বন্দী করে রেখেছে যে, তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়। সত্যি কথা। আমি ঐ সাতষট্টিটা তারের দায়িত্বেই ছিলাম। খুঁতবিশিষ্ট শত্রুপক্ষ থেকে ওদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার ছিল আমার। দিবা-রাত্রির ভেদ না রেখে ক্রমাগত আমি বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং ফোনকলগুলোর দেখভাল করেছি। কেবল একবারই আমি একটা তার নষ্ট করেছিলাম। আমাকে ঐ পোল থেকে নামিয়ে আনার কিছুদিন আগের ঘটনা সেটা।

সেই শহর বলতে এখন বাকি আছে কিছু ছবি মাত্র। আমি যদি সেই নষ্ট করে ফেলা তার দেখিয়ে দিই, আমাদের গার্ডরা ঐ গোলোকধাঁধাঁর ভেতর প্রবেশ করতে সক্ষম হবে, ছবির সুতোকে একের পর এক সংযুক্ত করে ঐ ঘরে পৌঁছে যাবে যেখানে সেই ভিন্নভিন্ন কণ্ঠস্বরের বসবাস। আমার সামনে সেই সাতষট্টিটা তার, যা ছিল আমার জীবনের সমতুল্য। এর মধ্যে একটা মাত্র তার তাদেরকে ঐ নারী পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম। আমি জানি সেটা কোনটা। কিন্তু আমি তা কাউকে বলবো না। (ইংরেজি অনুবাদ : জর্জ হেনসন)


রাজকীয়
এক বার্তা ।। ফ্রাঞ্জ কাফকা

মহান সম্রাট এক সংবাদ পাঠিয়েছেন, সরাসরি তার মৃত্যুশয্যা থেকে, শুধুমাত্র তোমার মতো এক দুর্দশাগ্রস্ত প্রজাকে, যে কিনা মহামহিমের আলোকছটার একদম প্রান্তসীমায় আশ্রিত নেয়া এক মৃদু ছায়ামাত্র। সম্রাট তার দূতকে আদেশ করেছিলেন তার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসার জন্য, তারপর তার কর্ণকুহরে ফিসফিস করে তিনি তাকে শুনিয়েছিলেন সে সংবাদটুকু। সঙ্গে সঙ্গে দূতের মুখে পুরোটা সংবাদ তিনি পুনরাবৃত্তি করে শোনেন। পুরো সংবাদটা পুনরায় শোনার পর তিনি মাথা নেড়ে তার নির্ভুলতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করার উদ্দেশ্যে হাজির বিশাল জনসমষ্টি, সমস্ত বাঁধাবিঘ্ন অপসৃত করে এসে হাজির হয়েছিল তার চারপাশে বৃত্তাকারে, ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সিঁড়ির ওপরে। এদের সকলের উপস্থিতিতে সম্রাট তার দূতকে ছেড়ে দিলেন সংবাদ পৌঁছানোর গুরুভার কাঁধে দিয়ে। শক্তপোক্ত গড়নের শ্রান্তিহীন সে দূত সঙ্গে সঙ্গেই ছোটা আরম্ভ করলো। দ্রুতগতিতে হস্তসঞ্চালনের মাধ্যমে সে ভিড়ের মাঝে জায়গা করে নিতে থাকলো। কোথাও শক্ত বাঁধার সম্মুখীন হলে সে তার বুকে খচিত সূর্যের চিহ্ন দেখাতো। এভাবে সে সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, অন্য সকলের চে' দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। কিন্তু জনতার ভিড় ছিল প্রকাণ্ড, তাদের অবস্থানের ব্যাপ্তি ছিল অসীম। যদি তার ছুটে চলার পথ হতো এক খোলা মাঠের বুক চিড়ে, তবে হয়ত শীঘ্রই তোমার দরজায় তুমি তার মুষ্ট্যাঘাত শুনতে পেতে। তার বদলে, তার সমস্ত প্রচেষ্টাই যেন পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হচ্ছিল। তাকে তখনও প্রাসাদের ভেতরের ব্যক্তিগত কক্ষগুলোর ভেতর দিয়ে ছুটে চলা লাগছিল। এর ভেতর দিয়ে তার ছুটে চলা কখনো শেষ হওয়ার নয়। আর তা যদি শেষও হয়, তবুও তাকে বিশেষ কোন অর্জন বলা যাবে না। কারণ তারপর তাকে যুঝতে হবে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিঁড়িপথের সঙ্গে, শেষমেশ এটাও যদি শেষ হয়, তবুও তা বিশেষ কোন অর্জন বলে ধর্তব্য হবে না। তাকে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে যেতে হবে প্রাসাদের উঠোনকে পায়ের নিচে ফালি ফালি করে, আর সে উঠোনের পর ভেতরের প্রাসাদটিকে ঘিরে রাখা আরেকটি প্রাসাদ এসে হাজির হবে, তারপর তাকে অতিক্রম করতে হবে সেই প্রাসাদের সিঁড়ি, উঠান, এবং তারপর আরও একটি প্রাসাদ, আর এভাবেই অতিবাহিত হবে হাজার হাজার বছর। যদি সে কোনোক্রমে সবশেষ প্রাসাদের দরজাটাও অতিক্রম করতে সক্ষম হয়, যা আদতে কখনোই কখনোই হওয়া সম্ভব নয় যদিও, তবে তারপর তার সম্মুখে এসে হাজির হবে- দুনিয়ার কেন্দ্র : উঁচু পললে পূর্ণ তার রাজকীয় রাজধানী। কেউই এসব বিঘ্নের পর্বত অতিক্রম করে শেষমেশ বাইরে আসতে পারে না, বিশেষ করে এক মৃতব্যক্তির তরফ থেকে সংবাদবাহী কেউ তো অবশ্যই নয়। অথচ তুমি তবুও বসে আছো তোমার জানালায়, সন্ধেবেলা এক সংবাদবাহীর কাছ থেকে সংবাদ লাভের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। (ইংরেজি অনুবাদ : ইয়ান জনস্টোন)


ত্রয়ী ।। আন্তোনিও লোপেজ ওর্তেগা

ভিন্ন তিন পুরুষের ঔরসজাত তিন পুত্র সন্তান আমার। প্রথমজনের বাবা ছিল কুর্দিস্তানের সংগ্রামে বাস্তুচ্যুত এক প্যারিস নিবাসী কুর্দি; দ্বিতীয়জন ছিল বেলজিয়ামের এন্টওয়ার্প এলাকার বংশোদ্ভূত, ওদের দেশের অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা; তৃতীয়জন ছিল চিলির এক পেইন্টার, যার স্টুডিও ছিল প্লেস ডি' ইতালিয়াতে। ফ্রান্সে তরুণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমার অবস্থানের সময় এ তিনজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়।

তীব্র ভালোবাসা ও আবেগ সহকারে আমি আমার তিন ছেলেকে বড় করেছি। ক্যারাকাসে ফিরে আসার পর, আমার আম্মাকে তার সান বারনাদিওর বাড়িতে আমাদের আলাদা জায়গা করে দেয়া লাগে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে বাগানে খেলে। তিন ভাইয়ের তিনরকমের বংশপদবী হওয়ায় ওদের স্কুলে ভর্তি করার সময় কিছু জটিলতার মধ্য দিয়ে যাওয়া লাগে।

প্রত্যেকে নিজ নিজ পিতার মতো ভিন্ন ভিন্ন কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে : সবচেয়ে বড়জনের চোখের মণি সবুজ রঙের, আর উচ্চতা ওর কুর্দি বাবার মতো; মেঝোজন পেয়েছে তার বেলজিয়ান বাপের স্ট্রেট চুল, আর বেপরোয়া ভাব; তৃতীয়জন পেয়েছে তার চিলিয়ান বাপের আত্মমগ্নতা। বৈচিত্র্যের মাঝে এই ঐকতান আমার ভালো লাগে। যেন আমার অতীত নবলব্ধ স্নিগ্ধতা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে বাড়ি জুড়ে, যেন পৃথিবীর সমস্ত বৈচিত্র্য এসে জড়ো হয়েছে আমার বাড়ির উঠোনে।

যাপিত মুহূর্তগুলো কখনো শক্তিশালী আবার কখনো দুর্বলতায় পূর্ণ; কখনো ভালো, কখনো মন্দ। কিছু দিন আনন্দে পূর্ণ (জন্মদিনের উৎসব, কিংবা আমাদের ডে-ট্রিপগুলি), কিছু দিন একদম ভঙ্গুর (ছোটটার নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার ব্যাপারটা)। ছেলেগুলো বেড়ে উঠছে অতীতের ছায়া মুছে, আর আমি চেষ্টা করে গেছি ক্রমাগত পিতৃত্বের বিষয়টাকে মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকার উষ্ণ স্নেহমাখা অনুভূতি দিয়ে ম্রিয়মাণ করে তুলতে।

ওদের চেহারার মাঝে আমি ওদের বাবাদের খুঁজে পাই। প্রত্যেকেই অবিমিশ্র ধারাবাহিকতার বাহক : ক্যাফেতে দেখা হওয়ার দিনগুলো, পার্টিতে বা পার্কে, সিনেমা হলে বা জাদুঘরে কাটানো সময়গুলোর প্রতিচ্ছবি। দূরবর্তী এক পৃথিবীর যোগসূত্র তারা : আক্রান্ত হওয়ার ভীতিগ্রস্ত কুর্দি (যে কিনা কোন ক্যাফেতে দুদণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারতো না, প্রতিনিয়ত চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া) থেকে শুরু করে বেজলিয়ানের কূটনৈতিক স্থিরতা হয়ে চিলির সে পেইন্টারের প্রবল ভালোবাসার তোড়, যে কিনা ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে পড়তো তার ক্যানভাস থেকে আমার শরীরে, আবার শরীর থেকে ক্যানভাসে। এ সমস্ত প্রাচুর্য আমার আপাদমস্তক প্রবাহিত হতে থাকে, আমি কেঁপে কেঁপে উঠি, ফেলে আসা দিনগুলোর প্রবল আকর্ষণে।

বড়সড় কোন ট্রমার অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমার ছেলেগুলো বড় হয়ে উঠেছে, এবং বলা যায় যে তারা এখন তরুণ। কি লজ্জার ব্যাপার—জীবনে এতো বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও এখন আর কোন পুরুষ মানুষ আমাকে কামনা করে না। সময়ে সময়ে এখনো আমি বের হই ডেটা কারো না কারো সাথে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আলাপের সময় আমার ছেলেদের কথা উহ্য রাখার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। প্রতিদিন এখন আমার ছেলেরা আমার চে' ওদের নানির সঙ্গে বেশি সময় কাটায়। আমি জানি যে বাসায় ওরা ভালোই থাকবে। ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে ঘোড়াটা এই উদ্বিগ্নতার দিনগুলিতে একটা সমস্যাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য কিছু বন্ধুদের সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়াই, নতুন কিছু পুরুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। কেবল এইবার আমি সতর্ক হয়েছি, পেছনে কোন চিহ্ন না রেখে যাওয়ার ব্যাপারে। (ইংরেজি অনুবাদ : নাথান বুডফ)


চূর্ণবিচূর্ণ ।। শিরানি রাজাপাক্ষে

সে হেঁটে চলেছিল আপন মনে, যখন সে প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। শ্রুতিযোগ্য শব্দের মাত্রাকে ভেঙ্গে চুরে ফেলে সে বিস্ফোরণ, স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সে রাস্তার ওপর থেমে যায়, যাওয়ার মতো কোন জায়গাই ছিল না। তার পা দুটো আকাশমুখী হয়ে উড়ে চলে, চুল ছড়িয়ে পড়ে ফুটপাথ জুড়ে। চারপাশ জুড়ে বজ্রপাতের মতো আলোর ঝলকানি। মাথার ভেতরে সে বজ্রপাতের গর্জন। তার বাম কানের পর্দা এক তীক্ষ্ণ কর্কশ শব্দের ঝনঝনানিতে কেঁপে ওঠে, এবং এক পর্যায়ে সইতে না পেরে ছিটকে বেরিয়ে আসে। চোখের কোনা দিয়ে সে দেখতে পায়, তার কানের পর্দা রাস্তার ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে, আশ্রয়ের খোঁজে, অন্য কোথাও, তার সজোরে প্রকম্পিত কানের আশ্রয় ছেড়ে।

কেউ একজন তার হাত মাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার পর নিদিশা টের পায় যে সে ভূমিতে শয্যাশায়ী। মাথার ওপর তীক্ষ্ণ সূর্যালোক আর চোখের তারায় নাচতে থাকা হাজারো আলোর ঝলসানিতে সে তাকে মাড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিকে সে দেখতে পারে না। বৌদ্ধ পূর্ণিমার পার্বণে আশেপাশের সমস্ত বাড়ি সজ্জিত ছিল লাল-নীল-সবুজ-হলুদ রঙের বাতিতে। নিদিশা চিৎকার করে উঠতে চাইলো, কিন্তু তার চেরা কণ্ঠনালি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়েছিল তার পাশে, রাস্তায়। সে কিছু শুনতে পাচ্ছিল না, কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, কিছু বলতে পারছিল না। যেন সেই তিন জ্ঞানী বানর একত্র হয়ে মিশে গেছে নিদিশার ভেতরে। হচ্ছেটা কি এখানে, আসলে?

সে নড়তেও পারছিল না। কিছুক্ষণ আগেও যে ফুটপাথ ধরে সে হেঁটে যাচ্ছিল, নিদিশা অনুভব করলো যে সে ফুটপাথের ওপরেই সে শুয়ে আছে। সে কিছু একটা অনুভব করতে পারছিল, কিন্তু সেটা যে আদতে কি—তা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় ছিল না তার। ওটা কি তবে তার হাত, যা মাড়িয়ে গেলো কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন? নাকি এটা তার শরীর থেকে কিম্ভূতকিমাকার উপায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা তার পা? কি সেটা? সে বিস্মিত হয়ে চিন্তা করে। একটু পরেই সে আবিষ্কার করতে পারে ব্যাপারটা—সে আর আদতে নেই সেখানে।

কেউ একজন তার রাস্তার ওপর হাঁটার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। সে নারী তার বুকে বোমা বেঁধে অদূরেই নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে কিছু আগে। এটাই সেই বজ্রপাতের চেয়েও বিকট শব্দ, যা তার কানে এসে হানা দিয়েছে, এবং তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে মিনিটখানেক আগে। তবুও নিদিশার মনে হয়, সে যেন নড়ছে একটু একটু, তার ভেতরে এখনো বাসনা সজাগ, হেঁটে হেঁটে সেদিকে চলে যাওয়ার, যেখানে তার যাবার কথা ছিল। কিন্তু কীভাবে? কোথায়?

সে নিজের চারপাশে উষ্ণতার প্রস্রবণ অনুভব করে। বৃষ্টি ছাড়াই তরলে পূর্ণ খানাখন্দ জমে গিয়েছিল চারপাশে। খরখরে সূর্য চারপাশে পাক খেতে থাকা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী অতিক্রম করে তাকে ঝলসে যাচ্ছিল। শীঘ্রই সেই খন্দগুলো পরিণত হয় ছোটখাটো ডোবায়, এবং ডোবা থেকে পরিণত হয় এক প্রস্রবনে। তারপর সে তরলের স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত সমুদ্রের দিকে। নিদাশার শরীর নিঃসৃত তরল প্রবল বেগে প্রবাহিত হতে থাকে ফুটপাথ আর রাস্তা জুড়ে। খুব শীঘ্রই যে এই স্রোত সমুদ্রে গিয়ে মিশবে, তাতে তার কোন সন্দেহ ছিল না। সে প্রবাহিত হয়ে চলল, এবং তার সঙ্গে আরও অনেকের প্রবাহ গিয়ে মিশ্রিত হল। ছোট ছোট স্রোত, প্রত্যেকেই উত্তর প্রয়োজন এমন কিছু প্রশ্ন বুকে নিয়ে বয়ে চলল সমুদ্রের পানে। তারা পরিণত হল এক নদীতে। তারা প্রবাহিত হয়ে চলল তাদের বুকে জড়িয়ে ধরার অপেক্ষায় থাকা সমুদ্রের দিকে।

তার শরীরের চারপাশে থাকা মানুষগুলো ততক্ষণে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। সৌভাগ্য যে, তাদের মাথাগুলো অন্তত তাদের সাথে ছিল। সে কিছু দেখতে পারছিল না, শুনতেও পারছিল না প্রায় কিছুই, কিন্তু তখনও তার অনুভব শক্তি প্রখর ছিল। মাছির মতো মানুষ জড়ো হচ্ছিল দলে দলে, সে ভিড় বাড়তেই থাকবে ক্রমাগত। আর এসব কিছু ঘটলো, কেননা সে আতঙ্কবাদীদের হুমকি ধামকি আমলে না নিয়ে তার কাজে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছিল সেদিন। এমন কী অপরাধ ছিল এতে?


ক্ষত ।। স্টুয়ার্ট ডেইবেক

সে এসেছিল ছেলেদের একটা সাদা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে, সাথে ছিল ফেডেড নীল ডেনিমের জাম্পার—যা তার নীল চোখকে আরও নীল করে তুলছিল।

"দেখো," কাউচে বসে সে ধীরে ধীরে তার জাম্পারটা উঠিয়ে এনে, পায়ের রানের কাছটায় একটা ক্ষত দেখাল।

সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। নানা রঙে রঙিন আচ্ছাদনে শরীর মোড়ানো দাড়িওয়ালা কিছু রঙমিস্ত্রী বাড়ির বাইরের দেয়ালটাকে এপাশ ওপাশ থপাস থপাস করে সাদা রঙে মুড়ে দিচ্ছিল। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল দেয়ালের ক্ষয়ে যাওয়া পুরোনো রং ঘষে ঘষে তোলার এবং নতুন রঙে রাঙানো পেইন্ট ব্রাশের সঙ্গে দেয়ালের বাড়ি লাগার শব্দ।

"শালার পুরানা দেয়াল তো দেখি রং একদম শুষে খেয়ে ফেলে," রঙমিস্ত্রীদের একজন কিছুক্ষণ পরপর এই কথা বলছিল।

"আমার শরীরে অল্পতেই ক্ষত হয়ে যায়," সে এমনভাবে গলা নামিয়ে কথাটা বলল, যেন বাইরের রঙমিস্ত্রীরা শুনে ফেলবে তার কথা।

ওর পা জোড়া মুড়িয়ে রাখা রংচটা নায়লনের নেটের নীচের ক্ষতটা নীল হয়ে এসেছিল। ব্যথা পাওয়া জায়গাটা ছিল তার পাছার একটু নিচে। ক্ষতের খানিক ওপরেই দেখা যাচ্ছিল তার কালো লেইসের পেন্টি। দিনটা ছিল অত্যন্ত গরম, নব্বই ডিগ্রি ফারেনহাইটের কাছাকাছি, এবং মেয়েটা তার কাপড় সরিয়ে রাখার পর সে যখন ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করে দেখছিল, তখন মনে হল, এখনো, এই মুহূর্তেও, ভিন্ন এক পথ বেছে নেয়ার একটা সুযোগ আছে তার হাতে। বাহির থেকে মনে হলেও এখনো তাদের মধ্যে এই ব্যাপারটা একটা কানাগলিতে এসে ঠেকে নি। ক্ষতস্থানটা নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, এখনো তাদের মধ্যে সাংকেতিক বাক্যবিনিময় ছাড়াও কথোপকথন সম্ভব। জীবন তাদের যে-রকম বল্গাহীন দিকনির্দেশনার দিকে ধাবিত করছে, তা বদলানো সম্ভব। আর তার জন্য কোন দৈবের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই, হয়ত খুব সাধারণ কিছু বাক্য বিনিময়, হঠাৎ প্রজ্ঞাপূর্ণ এক আলাপের সূত্রপাত, বা একটা চুটকি, বা খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন সে কাজ করে দেবে। হয়ত সে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, এই অসম্ভব গরম একটি দিনে সে কেন পেন্টি হোস পরে আছে। কারণ কি এটা যে, তার পা এখনো যথেষ্ট পরিমাণ ট্যান হয়নি? কাউচ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে হয়ত তাকে এই প্রশ্ন করতে পারে যে—সে লেমনেড পান করবে কিনা। মেয়েটা হ্যাঁ বললে সে পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হবে রান্নাঘরে, তারপর ফ্রিজে রাখা লেবু কচলে, চটকে সত্যি সত্যি লেমনেড বানানোর প্রস্তুতি নেবে সে। ভিনেগার এবং পানি মিশ্রিত লেবুর ঠান্ডা রসকে সে নাড়াতে থাকবে বরফের সঙ্গে সেঁটে লেগে থেকে ফিসফিসানো সাদা চিনের দানার সঙ্গে। বরফের কিউবগুলো ঘর্মাক্ত কাঁচের গ্লাসের গায়ে মন্দিরের ঘণ্টার মতো টুংটাং আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকবে।

তারা বসে একসঙ্গে ঠান্ডা লেমনেডের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আলাপ করতে পারে সহজ সরল বিষয় নিয়ে, যেমন—আবহাওয়া, কিংবা রঙমিস্ত্রীদের নিয়ে খুচরো আলাপ করতে করতে। তাদের এই সহজ আলাপের হেতু এটা নয় যে কথা বলবার মতো আকর্ষণীয় বিষয়ের অভাব আছে দুনিয়ায়, বরং এটা যে—আজ গ্রীষ্মকাল এবং অতিরিক্ত গরম, এবং মেয়েটা সম্ভবত এই উত্তাপের ব্যাপারে সচেতন নয়।

বরং সে তার পা জোড়া এমনভাবে আড়াআড়ি রেখে বসলো যে, তার পোশাক আরও ওপরে উঠে গেলো, এবং মেয়েটার শরীর আরও ঝুঁকে এলো তার দিকে। এমতাবস্থায়, মানুষ সাধারণত যেভাবে লিফটের বোতামে আঙুল রাখে, তার চেয়েও আলতো করে সে তার আঙুল স্থাপন করলো মেয়েটার ক্ষতস্থানের ওপর।

"আহ,"—তার ঠোঁট নড়ে উঠে এই শব্দের সমানুপাতিক একটা কাঠামো তৈরি করলো, যদিও আওয়াজটা পুরোপুরি বেরুলো না তার কণ্ঠ থেকে। সে লম্বা করে শ্বাস ছেড়ে তার নীল চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। তারপর চোখকে আরও ড্যাবড্যাবিয়ে খুলে, বিস্ময়ভারাতুর নয়নে মেয়েটি তাকাল তার দিকে। তারা দুজন বসেছিল খুব ঘন হয়ে, তাদের দুজনের চেহারা একে অপরকে স্পর্শ করেছিল প্রায়।

সে ক্ষতের ওপর থেকে আঙুল সরিয়ে নেয়ার পর মেয়েটা তার পেন্টিহোসের নেটকে আরও টেনে সরিয়ে দিলো, যেন বা সে নীল রঙের ভিন্ন ভিন্ন আস্তর আরও ভালো করে দেখতে পারে ওর পায়ে। হালকা সবুজ রঙের প্রান্ত আভার মতো ঘিরে রেখেছিল ক্ষতস্থানটাকে। ম্যাপের ওপর অঙ্কিত নদীর মতো দেখতে বেগুনি রঙের ছোট ছোট উপশিরা ছোট ছোট ভাঙ্গনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দশদিকে। ক্ষতের ঠিক মাঝখানটা ছিল গাঢ় বেগুনি রঙের।

"দেখতে কুৎসিত লাগছে জায়গাটাকে, তাই না," মেয়েটা ফিসফিস করে প্রশ্ন করে।

সে উত্তর না দিয়ে আলতো করে তার আঙুল বসিয়ে দেয় মেয়েটার ক্ষতের ওপর, আরও গভীরভাবে। মেয়েটা তার মাথা এলিয়ে দেয় পেছনে রাখা কুশনে। এবারে তার মুখনিঃসৃত আহ শব্দটা স্পষ্ট শোনা গেলো। সে চোখ বন্ধ করে দু পা ছড়িয়ে দিলো দুপাশে। আঙুল চালিয়ে দিলো রানের ফাঁকে। কণ্ঠে অস্ফুট গোঙ্গানোর শব্দ। তারা এতোটাই ঘন হয়ে বসেছিল যে, মেয়েটার পেন্টিহোসের নেটের ওপর নখের ঘর্ষণ সজোর আওয়াজ বাইরের রঙমিস্ত্রীদের কানে গিয়ে আটকাবে বলে মনে হচ্ছিল। মেয়েটার দু'পাশে ছড়িয়ে রাখা পায়ের ওপর দিয়ে, তার কোলের ওপর সে তার দু হাত স্থাপন করলো। নাইলনের নেটের নীচের নরম লোম হাতে এসে ঠেকল। কাঁচের দরজার গায়ে লেগে থাকা গ্রীষ্মকালের উত্তাপের মতো সত্যিকারের উত্তাপ এসে ধাক্কা দিলো তার হাতের তালুতে।

সে তার ক্ষতস্থানে আলতো করে চাপ দিয়ে চলল ক্রমাগত। প্রতিবারেই মেয়েটির ঠোঁট স্বরবর্ণ উচ্চারণের আকৃতি গ্রহণ করলো, তার কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দ হয়ে উঠলো ক্রমশ বিস্ময়াভিভূত।

বাইরে, বাড়িটি হয়ে উঠছিল সাদা হতে আরও ধবধবে সাদা। গ্রীষ্মকালীন রোডের ধোঁয়া ওঠা সোনালি রং হারিয়ে যাচ্ছিল গাছের শাখাপ্রশাখায়। আর সে ক্ষত—যার উৎপত্তির ব্যাপারে ছেলেটা একবারের জন্যও কিছু জানতে চাইলো না মেয়েটার কাছে, তা ছড়িয়ে পড়লো গোটা আকাশ জুড়ে।


প্রথম প্রতীতি ।। রিকার্ডো সুমালাভিয়া

আমার হাইস্কুল জীবনের শেষবর্ষের অন্তিম মাসের ঘটনা। বিকেলবেলাগুলোতে আমি এক ছোট প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করা শুরু করেছি। আম্মা বাঁধা দেন নি। প্রেসের মালিক, আর তার স্ত্রীও ছিলেন আমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ। তার স্ত্রী, এক বিশাল ও আকর্ষণীয় শারীরিক কাঠামোর ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে প্রায়ই বেড়াতে আসতেন, এবং আমার আম্মা তার অনুকরণে চুল কাটার ও রং করবার নিত্যনতুন স্টাইল শিখতেন। এদিকে আমি প্রকাশনা ব্যবসার খুঁটিনাটি এতোটাই আগ্রহ নিয়ে শিখছিলাম, যতটা আগ্রহ থাকে মানুষের নতুন কবিতা ছাপার হরফে দেখবার। প্রাথমিকভাবে আমার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব ছিল লেড নির্মিত লেটার টাইপোগ্রাফিগুলো ঠিকঠাক মতো প্লেটের ওপর বসানো। আর আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করতাম অক্ষরগুলো যাতে এলোমেলো না হয়ে যায়, যেমনটা হয়ে যেতো সিনোরা লিওনর, আমার ছাপাখানার মালিকের স্ত্রী সময়ে সময়ে এসে হাজির হলে। সেক্ষেত্রে আমার আবার পুরো অক্ষরগুলোর সেট শুরু থেকে সারিবদ্ধভাবে একে একে সাজানো লাগতো। সিনোরা লিওনরের উপস্থিতি আমার জন্য ছিল বরাবরই অস্বস্তিদায়ক, এবং তিনি সেটা বুঝতেন। আমার অনুমান, আমি নিজে ব্যাপারটা টের পাওয়ার অনেক আগেই তিনি তা আঁচ করেছিলেন। বিশেষ করে আমি যখন ছোট ছিলাম, গাড়ি নিয়ে খেলবার ফাঁকে যখন আলতো করে তার পা অথবা নিতম্ব ছুঁয়ে ফেললে এক ক্ষণস্থায়ী ভালো লাগা আমাকে গ্রাস করে নিতো। তারপর, এক পর্যায়ে আমাকে বাড়ির ভেতর থেকে উঠানে পাঠিয়ে দেয়া হতো, আর আমি সিনোরা লিওনরকে তার সে তড়িৎ-আকর্ষী হাসি (যা আমাকে এতোগুলো বছর পর, তার স্বামীর ছাপাখানায় বসেও তড়িতায়িত করে রাখে) কে পেছনে ফেলে চলে আসতাম। ছাপাখানায় তার হুটহাট উপস্থিতি আমাকে আরও অধিক অস্বস্তিতে ফেলে দিতো : আর সে অপ্রতিভ আবেগ আমি উগরে দিতাম আমার কাঁচা হাতের লেখা কবিতায়। যদি প্রবল লজ্জায় সে কবিতা আগেই নষ্ট না করে ফেলতাম, তবে আমার সে সৃষ্ট কর্মের স্থান হত এক লুকানো কাঠের বাক্সে, দিনের অন্যান্য কাজের সাথে।

এভাবেই দিন গড়িয়ে মাস, আর মাস গড়িয়ে বছর হল। আমার হাইস্কুল শেষ হল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই ছাপাখানার মালিক আমাকে পুরো বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ ফুল-টাইম চাকুরে হিসেবে গ্রহণ করলেন পরের বছরের জানুয়ারি মাস থেকে। তার স্ত্রী, ছোট-লাল রঙের চুল, আর ষাট ছুঁই ছুঁই নারীর ফ্যাশনের সঙ্গে যায় এমন গ্রীষ্মকালীন মিনিস্কার্ট পরে ছাপাখানায় আসা-যাওয়া আরও অনেক বাড়িয়ে দিলেন। এখানে স্বীকার করে নেয়া ভালো যে, তার ফ্যাকাশে ত্বকের সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টিকারী রঙের চুল আমাকে প্রাণিত করেছিল, (আমার বিবেচনায়) আমার সবচেয়ে লম্বা, এবং সেরা কবিতাটি লিখতে। সেটাই তখন পর্যন্ত আমার একমাত্র কবিতা, যা আমি দ্বিধাহীনভাবে ছাপাখানার টাইপের অক্ষরে সাজিয়েছিলাম, এবং প্রস্তুত হয়েছিলাম মনে মনে—আমার প্রেরণা দেবীর হস্তে অর্পণের জন্য। মনে মনে আমি হাজারটা পন্থা বুনে চলেছিলাম তার হাতে কবিতাটা তুলে দেয়ার, তবে নিশ্চিত ছিলাম যে, পন্থা যাই হোক—তার দিক থেকে নীরবতাই হবে প্রত্যুত্তর। হয়ত গালে আলতো করে একটু চুমু খাবেন সঙ্গে, অথবা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেবেন আমার চিবুক।

তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, তার ছাপাখানা প্রদর্শনের সাধারণ সময়। তার স্বামী তখন কাগজ কিনতে বাইরে ছিলেন। সেই ফাঁকে আমি প্লেটের ওপর অক্ষর সাজিয়ে কবিতাটা ছাপিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনি সিনোরা লিওনর এসে উপস্থিত হলেন, লাল কেশে, মিনিস্কার্টে, গ্রীষ্মকালীন রৌদ্রের তাপে একদম ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ত্বকে। এই মুহূর্তে আমার স্পষ্ট মনে নেই যে তিনি ঠিক কি বলেছিলেন, স্রেফ এতোটুকু মনে পড়ে যে, তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে তার কাছে আসতে বলেছিলেন। আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য আমাকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। তার ঠোঁটের কোনে তখনও সেই পরিচিত রহস্যময় হাসি। তারপর তিনি চুমু খেলেন আমায়। শরীরের কোথায় কোথায় সঞ্চালন করতে হবে, আমার হাতকে সে পথ তিনিই দেখালেন। আমি তার মিনিস্কার্ট টেনে খুলে ফেললাম, নামিয়ে ফেললাম তার পেন্টি ( সে যুগের বিবেচনায় জিনিসটা তেমন ফ্যাশন দুরুস্ত ছিল না, কিন্তু সে মুহূর্তে ওটাও আমাকে বিদ্যুতায়িত করেছিল) ঘোরগ্রস্থ মুহূর্তে আমি তাকে ঠেলে শুইয়ে দিলাম আমার কাজের টেবিলের ওপর। তার ওপর চড়ে বসলাম আমি। আমার শরীর তখন প্রবল আকর্ষণীয় সিনোরা লিওনরের শরীরের ওপরে। তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন প্রবল গোঙানো এবং হর্ষের সঙ্গে।

এভাবে পুলক ও প্রশান্তির চরমে পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা একটা লম্বা সময় অতিবাহিত করলাম। তিনি সেই টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আমি আমার কবিতার ভাগ্য আবিষ্কার করে বাকরহিত হয়ে গেলাম। তা তার শরীরের পেছনে ছাপা হয়ে গিয়েছিল। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, কবিতার শুরুর দিকের লাইনগুলো লেগে গিয়েছিল তার মেরুদণ্ডের কাছটায়, স্পষ্ট অক্ষরে। আর শেষের পঙক্তিগুলো নেমে এসেছিল তার পাছার ওপর, অস্পষ্ট ছড়ানো ঢ্যাবঢ্যাবে কালিতে। পরবর্তীতে নানারকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে কেন সেদিন আমি এ ব্যাপারে তার সামনে টু শব্দটিও উচ্চারণ করি নি। আমার চোখের সামনেই তিনি ধীরে ধীরে পোশাক পরেন, গভীর চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে আমরা আলাদা হই। তারপর ত্রস্ত হাতে আমি প্লেটের ওপর স্রেফ আমার কবিতার ধাতব অক্ষরগুলোকেই পুনর্বিন্যস্ত করে যাই। নিজেকে বলি, অন্য হরফগুলো অন্য কোন প্রেসের চাকরির অলস সময়ে বিন্যস্ত করা যাবে। (ইংরেজি অনুবাদ : ড্যানিয়েল অ্যালরকন)