প্রস্তুতিটা ভেতরে ভেতরে তখন হচ্ছেই : আসাদ চৌধুরী
২৫ মার্চে যেটা হয়েছিল সেটা সরাসরি বলা ভালো। আমি ভাবি, যে পাকিস্তানি আর্মি কোরআন-পতাকা ছুঁয়ে কসম খায়, দেশের জনগণকে রক্ষা করা, জনগণের সম্পত্তির নিরাপত্তা, সীমানা রক্ষা করা তাদের পবিত্র দায়িত্ব। তারাই কিনা আমাদের টাকায় বেতন খেয়ে সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে এভাবে মানুষ মারবে, বাঙালি মারবে, আমার কল্পনার বাইরে ছিল সেসব।
বাঙালি তো নিজের থেকে চিরকাল কোনো উদ্যোগ নেয় না, আঘাত পেলে পর সিরিয়াস হয়। জিন্নাহ যখন চিৎকার করে বললেন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে তখনই তো আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করলাম। বাংলা ভাষাকে নিয়ে অহঙ্কার, বাঙালি শক্তি নিয়ে অহঙ্কার এ তো আমাদের বরাবরই ছিল।
২৫ মার্চের ওই ঘটনার পর শত্রুদের তথা অত্যাচারী শাসকের দূর করতেই এরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এ প্রতিজ্ঞা তখন আমার এমন তীব্র যে, সেই তীব্রতা আমার এখনও কানে বাজে। বঙ্গবন্ধুর সেই কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বারবার আন্দোলিত করে আমাকে। বলা যায়, সেই মুক্তির সংগ্রামে আমি এখনো লেগে আছি।
আমাকে এখনো সেদিনের ঢাকার সেই আগুন, সেই রঙ, সেই লাল, সেই আর্তনাদ- এসব কিছু আমাকে কিছু একটা ভূমিকা রাখতেও উদ্বুদ্ধ করেছিল।
পরের দিন অনু, সজল নামে দুটি ছেলে (আমি জানি না, এখন ওরা কোথায় আছে?) এবং বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি মানে বডিগার্ডের মতো ছিলেন মহিউদ্দিন (তার বাড়িও কোটগাঁতে) এরা মুন্সিগঞ্জ থেকে অস্ত্র নিল, নারায়ণগঞ্জের ডিটেলস বর্ণনা দিল। নারায়ণগঞ্জে ও ঢাকায় কী কী হয়েছে, কীভাবে তারা মেরেছে এসব। ঢাকা থেকে বহু মানুষ মুন্সিগঞ্জে আসছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে কী হচ্ছে সব শুনলাম। আর যেহেতু জিনু চাকরি করতেন বিআইডিসিতে, উনি পুনরায় ফিরে গিয়ে চাকরি করবেন কি না এ নিয়েও আলাপ হচ্ছিল।
জিনুর পুরো নাম জিন্নাহ। ওনার আব্বার নাম লিয়াকত। বাবা মুসলিম লিগার। সেই বাড়িতে দুপুরবেলা লোকজন আসছে, ভাত খাচ্ছে। মানে প্রস্তুতিটা ভেতরে ভেতরে তখন হচ্ছেই। তখন কলেজ বা স্কুলের মাঠে বিরাট মিটিং হল। সেখানে ক্যাপ্টেন রউফ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি) বোধহয় তিনি এসেছিলেন। সেখানে তারা প্রতিশ্রুতি নিচ্ছিলেন যে, আমরা এর জবাব দিবোই। দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার যে আগ্রহ, তা ওখানে গিয়েই আমরা অনুভব করেছিলাম তীব্রভাবে।
ভুট্টোর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম : নির্মলেন্দু গুণ
এরপর ২৫ শে মার্চের রাত্রে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি ছিল (সৈয়দ আহমদ) ফারুক আর আনোয়ারুল আলম শহীদ ছিল জিএস। ওরা এসে আমাকে নিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হইলো না, কারণ বঙ্গবন্ধু ঘরের ভিতরে ছিলেন, হাই কমান্ডের সঙ্গে মিটিংয়ে ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার আলোচনা ভেস্তে গেছে, ইয়াহিয়া খান তার সাথে আর আলোচনায় আগ্রহী না, বঙ্গবন্ধু আরও চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাই দিস টাইম অপারেশন সার্চ লাইট প্ল্যান পুরোপুরি শেষ করে এনেছেন। হি ফ্লেড এওয়ে ইন দা ইভিনিং। আমরা সেটা জানতাম না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গট দ্য নিউজ দ্যাট হি লেফট বাংলাদেশ ইন দ্য ইভিনিং। কোনো রকমর ঘোষণা ছাড়াই ইয়াহিয়ার আকস্মিক চলে যাওয়ার মধ্যে বঙ্গবন্ধু একটা বিপদসংকেত পেলেন। ২৫ শে মার্চ রাত্রে এইটার মোকাবেলা কীভাবে করা যাবে এই নিয়ে তিনি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে, আর্মির সঙ্গে, বিডিআর-এর সঙ্গে, তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কথা বলবেন। ফলে ওই দিন তিনি আর অন্য কাউকে সময় দেন নাই। সন্ধ্যার পর তিনি আর এক মুহূর্তের জন্যও বাইরে বেরিয়ে আসেননি। সেদিন রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। শেখ হাসিনা বেলকনি থেকে আমাকে দেখে ভেতরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি যাইনি। বঙ্গবন্ধুর সময় নষ্ট করা হবে বিবেচনায় আমি আর যাইনি। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারি নাই। আমার সঙ্গে সেদিন সারাক্ষণ ছিলেন এপিএনের সাংবাদিক খালেদ চৌধুরী (প্রভু)।
২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাদের অবস্থানের সময়টা মিলে যাওয়ার কারণে হাসতে হাসতে আমি মন্টুর (পুরো নাম মোস্তফা মহসীন মন্টু, তিনি তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত সহচর, থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডে নেকরোজবাগে) কাছে জানতে চাই- সেদিন নেতার সঙ্গে আপনার শেষ কথা কী হয়েছিল, মনে পড়ে? আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা জানান, তা আমি কখনো পূর্বে শুনিনি। বঙ্গবন্ধু মন্টুকে বলেন, তোরা ইকবাল হল থেকে অস্ত্রশস্ত্রগুলো নিয়ে নদীর ওপারে চলে যা, আমি যদি কোনো কারণে সড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেই, তো আমি হামিদের বাড়িতে যাব। হামিদ? কে তিনি? আমি তো তাঁর নাম কখনো শুনিনি। মন্টু বলেন, এই হামিদ হচ্ছেন হামিদুর রহমান। আওয়ামী লীগের একজন নেতা। উনি সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পুরোনো ঢাকায় তাঁর বাড়ি। বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে। উনার কয়েকটি লঞ্চ ছিল। তার মানে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চের রাতে হামিদ সাহেবের লঞ্চ ব্যবহার করে বুড়িগঙ্গা নদীপথ ধরে কোথাও পালানোর কথাও ভেবেছিলেন? মন্টু বললেন, হ্যাঁ, সে জন্য আমি তারপর থেকে হামিদ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতাম।
শুনে আমার কেন জানি বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা মনে পড়ে যায়। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় এই নদীপথে পালাতে গিয়েই তো ভগবানগোলায় ধরা পড়েছিলেন নবাব সিরাজ। কে জানে সেই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনার কথা ভেবেই সেই রাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পালানোর, তাঁর নিজের ভাষায় ‘সরে যাবার’ বাতিল করেছিলেন কি না!
২৫ মার্চ রাতের বর্ণনা দিয়ে আমি ইয়াহিয়াকাল নামে একটি পালাকাব্য রচনা করি। শুরুটা এভাবে-
২৫ মার্চের রাতে ভুট্টো কোথায় ছিলেন ভাইজান?
২৫ মার্চের গণহত্যার ঐ কালরাতে
ইয়াহিয়া বিদায় নিয়া চইল্যা গেলেও,
নিজের চোখে গণহত্যা দেখার জন্য
ভুট্টো থাইক্যা গেছিলেন ঢাকাতেই।
সবসময় তো আর গণহত্যা দেখার
এইরকম সুযোগ আসে না।
আমরা তখন পুরোপুরি প্রতিরোধের জন্য তৈরি : মুহম্মদ নূরুল হুদা
‘প্রতিরোধ’ নামে একটা পত্রিকা যেটা ৬ মার্চ প্রকাশিত হয়ে যায়। এর সঙ্গে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম তাদের মধ্যে আমি, হুমায়ুন কবির, মুনতাসীর মামুন, সাযযাদ কাদির, খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক নওশাদ (কালপুরুষ-এর সম্পাদক) জড়িত ছিলাম। আর লেখক সংগ্রাম শিবিরটা ছিল প্রফেসর ড. আহমদ শরীফ-এর নেতৃত্বাধীন। আর আমরা ছিলাম পাঁচ তরুণ কর্মী। আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় নায়ক ছিলেন আহমদ শরীফ-এর পর পরই বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। উনিই আমাদের এই সংকলনটি প্রকাশ করার পয়সা দিয়েছিলেন।
প্রফেসর আনিসুজ্জামানের এক ভাইয়ের প্রেস ছিল পুরানো ঢাকায়, ওখান থেকেই এটা ছাপা হয় ৬ মার্চ। এবং ৭ মার্চ-এ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন আমরা বাংলাদেশের লেখক শিল্পীদের পক্ষ থেকে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ স্বাধীন করো- এই স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা আমরাও দিয়েছিলাম। এই সংকলনে যেসব কবিতা ছিল সবই ছিল স্বাধীনতার পক্ষের কবিতা। এই প্রথম বলা যেতে পারে গেরিলা লেখক হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। এখানে সবার নামই ছিল ছদ্মনাম। যেমন আমার নাম ছিল মুদনুল (মুহম্মদ নূরুল হুদা) রকনদ (রফিক নওশাদ), সাদকার (সাযযাদ কাদির), টেরোলিয়াস (খালেকুজ্জামান ইলিয়াস)। মানে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
আমাদের গেরিলা যুদ্ধে যেতে হবে এমন একটা বোধ থেকে পত্রিকাটি বের করি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেবার আগেই আমরা এই পত্রিকার হাজার দেড়েক বিলি করে ফেলি। এটা ছিল আট পৃষ্ঠার। এটি প্রকাশিত হবার পরপরই পাকিস্তানি ফোর্সের নজরে পড়ে যাই আমরা। এরপর বাংলা একাডেমির বটতলায় লেখক সমাবেশে একটা মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, যার যার এলাকায় চলে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের অর্গানাইজ করতে হবে সবাইকে। গোপন ট্রেনিং নেবার কথাও জানানো হয় ওই মিটিংয়ে।
আমি ১৪ তারিখে চলে যায়। চলে গিয়ে নিজ বাড়ি কক্সবাজারের ঈদগাহ মডেল হাইস্কুলের বিশাল মাঠে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন স্থানীয়ভাবে সামরিক বাহিনিতে কাজ করতেন হাবিলদার সুরত আলম। আর ঐ এলাকার একজন প্রাক্তন আর্মি, বোধহয় ক্যাপ্টেন ছিলেন, নাম আবদুর সোবহান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর তার লেখাও আছে। এই সময় আমাদের সঙ্গে হাইস্কুলের প্রায় সব মাস্টার (আলম মাস্টার, আমার চাচা ইলিয়াস মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কক্সবাজারের একজন) ও ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিয়েছিল। এটা ছিল ২৫ মার্চের আগে প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড।
২৫ মার্চের ঘটনার সময় আমি ওইখানেই। তখন আমরা অলরেডি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছি। একভাগ গেল আরাকান রোড পাহারা দিতে হাবিলদার সুরত আলীর নেতৃত্বে। আর আমার নেতৃত্বে একটি দল ছিল সেটা মহেশখালি অঞ্চলে পাহারাই ছিল। আমাদের অস্ত্র বলতে লাঠি আর গাদা বন্দুক। ওই সময় ডাকাতদের বেশ উৎপাত ছিল। আমাদের প্রধানতম একটা কাজ ছিল ওইসব ডাকাতদের পাহারা দেওয়া।
কক্সবাজারে কোনো আর্মি ক্যাম্প ছিল না। এক মাস পর মেজর জিয়া তার আর্মি নিয়ে চলে আসেন। ২৫ শে মার্চের রাতের ঘটনা আমরা কিছুই জানতাম না। পরদিন সকাল বেলায় আমরা রেডিওতে খবর শুনতে পাই। তখনো আমরা কিন্তু প্রশিক্ষণরত। চট্টগ্রাম স্বাধীন বেতার থেকে সব খবর শুনলাম। এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
ওই মুহূর্তে আমাদের কক্সবাজারে কোনোরকম লুটপাট হয়নি। আমরা তখন পুরোপুরি প্রতিরোধের জন্য তৈরি ছিলাম। আমরা যখন শুনলাম ঢাকা দখল হয়ে গেছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করা হয়েছে। তখন আমার একটা জিনিস মনে হয়েছিল এ পরাজয় আমাদের পরাজয় নয়। ২৫ শে মার্চের পরপরই আমার একটি পঙক্তি মুখে চলে এলো, ‘একবার পরাজিত হলে, পুনর্বার পরাজিত হবো এই ভয় থাকে না আমার।’
সর্বশেষ আমি বলতে চাই, আমার চেতনায় কাজে কর্মে এখনো মুক্তিযুদ্ধ চলছে।