একসঙ্গে ইফতারে ঘুচে যায় বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্ট

ঘড়ির কাঁটায় সেহরির সময় শেষ হতে আড়াই ঘণ্টা বাকি। হলের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একদল শিক্ষার্থী। ক্যান্টিন খোলার অপেক্ষায় তারা। তাদের কেউ কেউ আবার দ্রুত খোলার জন্য ক্যান্টিন পরিচালককে ডাকাডাকি করছে। রোজা শুরুর দিন থেকে এভাবেই প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ডাকাডাকিতে ক্যান্টিন খোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ক্যান্টিন পরিচালক জহির উদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলগুলোতেও একই চিত্র দেখা যায়। রাত ২টা বাজলেই ক্যান্টিনের সামনে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা।

হল থেকে বের হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেহরির অন্যতম উৎস বটতলার দোকানগুলো। বছরের পুরোটা সময় সবগুলো দোকান খোলা থাকলেও, রোজায় দিনের বেলা ক্রেতা নেই। তাই অনেক দোকানই বন্ধ থাকে। এখানেও রাত আড়াইটা থেকে শুরু হয় সেহরি করতে বিভিন্ন হল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। সবারই লক্ষ্য আগে আগে গিয়ে নিজের পছন্দমতো খাবার সংগ্রহ করা। দেরি হলে পছন্দমতো খাবার নাও পাওয়া যেতে পারে।

বলছি ঢাকার অদূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কথা। প্রায় সাতশ একরের এই ক্যাম্পাসটিতে সারা বছর শিক্ষার্থীরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে থাকলেও রোজার মাসে এখানে এক অন্যরকম আমেজ বিরাজ করে। দিনভর হলের ক্যান্টিন ও ক্যাম্পাসের বটতলায় শিক্ষার্থীদের আনাগোনা না থাকলেও সেহরি ও ইফতারে জায়গাগুলো হয়ে উঠে জমজমাট। বন্ধ ক্যাম্পাসে সেহরির সময়টা প্রতিযোগিতামূলক হলেও ইফতার হয় ছোট-বড়, বন্ধু-বান্ধবসহ সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে।

রোজায় শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও অনেক শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসে থেকে যায়। এদের কেউ টিউশন, কেউ পার্টটাইম জব আবার কেউ ক্যাম্পাসে রয়ে গেছেন চাকরির পড়াশোনার জন্য। সারা দিনের সকল ব্যস্ততা ছাড়িয়ে সেহরি ও ইফতারে একসঙ্গে মিলিত হয় এই শিক্ষার্থীরা। আবাসিক হলগুলোর ডাইনিং বন্ধ থাকায় ক্যান্টিন ও বটতলার দোকানগুলোতে সেহরিতে শিক্ষার্থীদের ভিড় নামে। তাই প্রায়ই খাবারের সংকট হয়। যেদিন সংকট বেশি, সেদিন রীতিমতো খাবার সংগ্রহে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সব মিলিয়ে সেহরিতে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয় শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থী হাবিবুল ইসলাম। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলেন সেহরি করতে। পরিবারের বাইরে এবারই প্রথম সেহরি করছেন। খাবারের সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেহরিতে ভালো ও পছন্দের খাবার পেতে হলে অনেকটা বেগ পেতে হয়। দেরিতে এলে অনেক সময় খাবার পাওয়া যায় না। তবে পরিবারের বাইরে বন্ধুবান্ধব মিলে সেহরি করার মজাটাও আলাদা।’

ইফতারের সময় হলে বটতলার দোকানগুলোতে ক্রেতার সমাগম পুনরায় বাড়তে থাকে। তবে সেহরির মতো খাবারের সংকট তখন থাকে না। ভাজা-পোড়া জাতীয় জিনিস হওয়ায় অনেক ভ্রাম্যমাণ দোকানি ইফতার সামগ্রী বিক্রি করেন। তাই সংকট কেটে যায়। হলের ক্যান্টিন, বটতলা কিংবা ক্যাম্পাস সংলগ্ন দোকানগুলো থেকে ইফতার কেনেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে ও ব্যাপক চাহিদা থাকায় ইফতার সামগ্রী বিক্রি করেন বলে জানান ক্যাম্পাসের দোকানিরা। তারা বলেন, ‘রমজানে ইফতারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে বিক্রিও বেশি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুসারে বিভিন্ন রকমের ইফতার সামগ্রী তৈরি করা হয়।’

তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে ইফতার ও সেহরির দাম নিয়ে হতাশ শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, ‘ক্যাম্পাসে ইফতার ও সেহরির দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দাম অনুযায়ী মানও ভালো হচ্ছে না। অনেক দোকানদারই নির্দিষ্ট দামের অতিরিক্ত রাখছে। বেশি দামের বিষয়ে কথা বললে তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ দেখান।’

এদিকে ইফতারকে কেন্দ্র করে আবাসিক হলের মাঠ, সেন্ট্রাল ফিল্ড, টিএসসি হয়ে উঠে জমজমাট। একে একে জায়গাগুলোতে মিলিত হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। সময় যত ঘনিয়ে আসে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। তাদের কেউ শরবত বানিয়ে সেটি পরিবেশন করে, আবার কেউ ছোলা মুড়ি-মাখিয়ে ইফতারের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এভাবেই প্রতিদিন গল্প-আড্ডায় উৎসবমুখর আয়োজনে ইফতার সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা জানান, ‘হলে একা ইফতার করে আনন্দ পাওয়া যায় না। সবাই মিলে ইফতারে পরিবারের আমেজ রয়েছে। একে অপরের খোজ-খবরও নেওয়া যায়। তাই ইফতারের সময় হলেই সবাই এক হয়ে যান।’

আল বেরুনী হলের শিক্ষার্থী রবিউল সানি বলেন, ‘পরিবারের চেয়ে আপন কেউ নেই। গত দুই বছর পরিবারের বাইরে ইফতার ও সেহরি করে তা ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছি। পরিবারের সেই আমেজ পেতে ক্যাম্পাসের বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়রদের সঙ্গে ইফতার করি। সবার অংশগ্রহণে ইফতারে ভালোই মজা হয়।’

প্রীতিলতা হলের শিক্ষার্থী আফসানা আক্তার বলেন, ‘সেহরি হলে করলেও ইফতার বাইরেই করা হয়। সেন্ট্রাল ফিল্ডে সবার সম্মিলিত ইফতার উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। সারা দিনের রোজা শেষে সবার একসঙ্গে ইফতারে মনটা ভালো হয়ে যায়। একসঙ্গে এতো মানুষের ইফতারের সৌন্দর্যই আলাদা।’

ক্যাম্পাসে সেহরি ও ইফতারে মিশ্র অনুভূতির কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ নং হলের শিক্ষার্থী মো. শাহীন রানা। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সেহরি ও ইফতার নিয়ে বলতে গেলে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। বাড়িতে থাকলে ইফতারের পর কি খাবো, সেহরিতে কি খাবো তা নিয়ে ভাবতে হতো না। কিন্তু ক্যাম্পাসে কোথায়, কখন, কী খাবো তা নিয়ে ভাবতে হয়। তবে ক্যাম্পাসে ইফতারের মুহূর্তটা ক্লান্তি, হতাশার গল্প পেরিয়ে ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দেয়। সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই একসঙ্গে ইফতারের আয়োজন করি। একেক দিন একেক জায়গায়, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সঙ্গে ইফতারের বদৌলতে দেখা হয়। গল্প হয়, ঘুচে যায় বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্ট।’