তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানকে ‘দ্বৈতনীতি’ বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে জঙ্গিদের মদদ দেয়, অন্য দিকে জঙ্গি দমনে কাজ করতে চায়। অনেকে আবার ‘বিচারহীনতার’ কারণে সরকারের সমালোচনা করে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। একইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনও ‘সুযোগ’ না দিয়ে ‘সজাগ’ থাকার প্রতিও তারা ইঙ্গিত করেছেন।
আইএস প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, এ তর্কের কোনও অর্থ নেই। জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। আর শাহরিয়ার কবির মনে করেন ‘সুযোগ’ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে ‘সজাগ’ থাকার কথা বলেছেন খুশি কবির।
সোমবার জুলহাজ মান্নান ও তনয় হত্যাকাণ্ডের পরপরই উদ্বেগ ও নিন্দা জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। এরপর বুধবার তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্প্রতি আলোচিত যেসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি সেগুলোর একটি দীর্ঘ তালিকা দেন। সাক্ষাৎ শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে আইএস আছে কিন্তু সরকার তা বিশ্বাস করছে না। আমরা বুঝতে পারছি বাংলাদেশ একা এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবাইকে এগিয়ে এসে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে কাজ করছি। বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য আমরা আগ্রহী।
তবে বার্নিকাটের মন্তব্যকে ‘আবেগময় বক্তব্য’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেছেন, দেশে কোনও আইএস নেই। এসব হত্যাকাণ্ডে দেশের জঙ্গিরাই জড়িত। তবে জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের কথা তিনি বার্নিকাটকে বলেছেন।
বার্নিকাটের বক্তব্যের পর আইএস প্রসঙ্গ আবারও আলোচনায় উঠে আসে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘সহায়তা’ করার আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে সচেতন নাগরিকদের মধ্যে শুরু হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সহায়তা’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সরকার যদি মনে করে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিদেশি সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন আছে। আমি তাতে আপত্তি করি না।’
আইসএস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার অনেকের বিরুদ্ধেই তো আইএসের লোক হিসেবে মামলা করছে। তো আইএস নেই, আইএস আছে- এই তর্কের আমি কোনও অর্থ বুঝি না।’
‘যুক্তরাষ্ট্রে দুজন বাঙালিকে হত্যা ছাড়াও যে সংখ্যক হত্যা-খুন হচ্ছে, সেগুলোর সুরাহা যদি তারা না করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে!’ মন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মুনতাসীর মামুনের।
তিনি বলেন, ‘জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক সাকসেসফুল (সফল)। যুক্তরাষ্ট্র যাদের দমন করতে পারছে না বরং সেসব ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের সহায়তা নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে এবং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে, এটাই হওয়া উচিত।’
‘আর বার্নিকাট তো বলবেই’ মন্তব্য করে মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, ‘বার্নিকাট দেখা করতে চাইলেই কেন আমাদের মন্ত্রীর দেখা পান? আমাদের অ্যাম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত) কি পারবে জন কেরির সঙ্গে দেখা করতে? কিংবা ওদের জার্নালিস্টরা কি এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বাসেডরের সামনে। তাই আমি বলব, আমাদের মান-সম্মান অধিকাংশই খোয়াচ্ছেন আমাদের সাংবাদিকরা। নইলে কোন দেশে আছে- অ্যাম্বাসেডরের সামনে গিয়ে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? কোনও সাংবাদিক কেন তাকে প্রশ্ন করল না যে- যুক্তরাষ্ট্রে বাসায় ঢুকে যে দুই বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের ঘাতককে তো ধরতে পারেননি এখনও। সেক্ষেত্রে আপনাদের বাংলাদেশ সাহায্য করতে পারি কিনা, এই প্রশ্নটা কেউ করতে পারল না তাকে! শুধু কথা বলে যাবে এক তরফা তাতো হয় না।’
বার্নিকাটের মন্তব্য বিষয়ে জানতে চাইলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যু্ক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাও জানে, আইএস, আল-কায়েদাসহ জঙ্গি-মৌলবাদীদের গডফাদার কে। আইএস-এর নেতারা, আলকায়েদার নেতারা- সবাই জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী আর মুসলিম ব্রাদার হুডের প্রতিষ্ঠাতার লেখা পড়েই সন্ত্রাসী হয়েছেন জোর করে ক্ষমতায় আসতে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রর অজানা নয়, তারপরও যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে মডারেট ইসলামি সংগঠন মনে করে। আমরা যখন জামায়াত নিষিদ্ধ করার কথা বলি, যু্ক্তরাষ্ট্র তখন বলে জামায়াত নিষিদ্ধ করা যাবে না, এটাতো যু্ক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাকে অথর্ব ভাবার কোনও কারণ নেই। সৌদি আরব যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামি এনজিও রাবেতা আল ইসলামের অর্থদাতা- এটা কে না জানে। বাংলাদেশের সব জঙ্গিদের তারা মদদ দিচ্ছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরাও লিখেছেন, আমাদেরও বহু গবেষণায় পেয়েছি— এগুলো সবাই জানে, কোনওটাই অজানা না।’
‘বাংলাদেশে জঙ্গি থাকলে যুক্তরাষ্ট্রর সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে, সেজন্যই তারা ওখানে সাইট ইন্টিলিজেন্স খুলে বসে রয়েছে। যে ঘটনাই ঘটছে, এরপরই তারা সেখান থেকে বলছে, আইএস করেছে।’ বলেন শাহরিয়ার কবির।
আিইসএস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, আইএস নেই, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ আইএস আছে কি নেই, সেটা জরুরি নয়, বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে এটা নতুন না। আইএস-আল কায়েদা জন্মের বহু আগে থেকেই জামায়াত মুক্তযুদ্ধের সময়ে তালিকা করে এভাবে হত্যা করেছে বুদ্ধিজীবীদের। এ সন্ত্রাসের রাজনীতি-দর্শন একটাই। এই দর্শনটা যদি যুক্তরাষ্ট্র আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বোঝেন, তাহলে কোনওদিন তারা এ জঙ্গি-সন্ত্রাস নির্মূল করতে পারবেন না। কেউ সন্ত্রাসের গডফাদারের দিকে আঙুল তুলছে না। আমরা বলছি, দেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইন আছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াতের বিরুদ্ধে কেন একটা মামলা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বহুবার বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী কোনও রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এগুলো জানার পরেও তাদের অনুসারীদের সন্ত্রাস করতে দিচ্ছি।’
বাংলাদেশে বা অন্যত্র যেসব সন্ত্রাস হচ্ছে, এটা মাফিয়াদের মতো নিছক সন্ত্রাস নয় উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই সন্ত্রাসের একটা রাজনৈতি দর্শন আছে, যেটা উপমহাদেশে মওদুদীবাদ বলি, ওহাবীবাদ বলি, রাজনৈতিক ইসলাম বলি, এটাকে সবার আগে নির্মূল করতে হবে। মূলত জঙ্গিবাদের গোড়া জামায়াতকে নির্মূল করতে হবে।’
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও দেশ যদি সাহায্য করতে চায়, আর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে যদি সেটা নিতে না চায়, তাহলে সেটা করতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকারের পলিটিক্যাল উইল এবং কমিটমেন্ট রয়েছে কিনা সেটা আগে দেখতে হবে। আর বার্নিকাটকে জিজ্ঞেস করতে চাই, তার দেশেও যেগুলো হচ্ছে সেগুলো সমাধান হচ্ছে না কেন।’
বার্নিকাটের মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে এখন এই সমস্যা, সবার ভেতরেই এটা ঢুকে বসে আছে। জুলহাজকে মারার পরে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষিপ্ত হয়েছে। ইউএস ফরেন সেক্রেটারি জন কেরি যখন এটা নিয়ে মন্তব্য করেন তখন বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এতে জড়িয়ে গেছে, এটা বার্নিকাটের বিষয় না, এখানে ওয়াশিংটন জড়িয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনও বিদেশি শক্তিকে প্রভাব খাটানোর মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়, সেটা ভারত, পাকিস্তান কিংবা ইউনাইটেড স্টেটস যে দেশেই হোক। ইরাকের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন তাদের সুযোগ দিয়েছিলেন বলেই যুক্তরাষ্ট্র সে সুযোগ নিয়েছিল। আমাদেরকে এক্ষেত্রে সজাগ থাকতে হবে, আমরা যেন কাউকে কোনও সুযোগ না দেই।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইএস আছে কি নেই, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এখানে বিচার হচ্ছে না। আর আইএস তো আছেই। সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলেও আইএসের লোক তো আছেই। আমাদের সরকার বিষয়টাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সক্ষমতা যেটুকু আছে তাতে আইএস নির্মূল করা যাবে কিনা, জানি না। কিন্তু প্রতিটা ঘটনার তো বিচার করা যায়। সরকার তো এগুলোকে একেকটা আলাদা অপরাধ বলে বিবেচনা করছে আর বলছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো যে রাজনৈতিক ঘটনা এবং একটা অপ-আদর্শকে ভিত্তি করে ঘটছে, সেটা তো সরকার উপলব্ধি করছে না।’
এদিকে, বৃহস্পতিবার মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখি, তাহলে সিরিয়ার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাকের কেন এ অবস্থা? শুধু দেশ নয়, বিশ্ব নিয়ে চিন্তা করুন, দেখুন, সেখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে। আর মায়ের চেয়ে মাসির কান্না যে বেশি, সেটাও আমরা দেখছি। আমার দেশ স্বাধীন দেশ, সরকার আছে, প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে। কোনও ঘটনা ঘটলে আমাদের দায়িত্ব খুনিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু অনেক দেশ এসে মায়াকান্না দেখায়। মায়াকান্না দেখিয়ে তারা চায় আমাদের পাশে আসতে। যেভাবে এসেছিল সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশের পাশে। সেসব দেশের অবস্থা আমরা দেখেছি। এজন্য এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
/এএইচ/এজে