নারী শ্রমিকরা জানান, কর্মক্ষেত্রে মজুরির বৈষম্য জেনেও জীবিকার তাগিদে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে, পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করলেও কখনও কখনও পুরুষ সহকর্মী, কখনও ঠিকাদারে হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাদের। এমনকি অনেক সময় নারী বলে কাজে নিতেও আপত্তি জানান ঠিকাদাররা। কাজের ধরন, সময় অনুসারে মুজরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম মজুরি পান। পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৩-৬শত টাকা মজুরি পেলেও নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় ১৬০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, অনেক ক্ষেত্রে ঘরেও নিগৃহীত হন তারা।
রাজধানীর সদরঘাটে নৌকা থেকে মালামাল নামাচ্ছিলেন রমিজা বেগম। মজুরি কত পান—জানতে চাইলে রমিজা বেগম বলেন, মজুরি চুক্তিতে হয়। কত বস্তা মালামাল নামালাম, সেটা হিসাব করে টাকা দেয়। এক বস্তা মাল নামালে পাই ২-৩ টাকা। পুরুষদের দ্বিগুণ দেয়। এটাই তো নিয়ম, কাজ এক রকম করলেও নারী বলেই কম মজুরি পাব।
আরও পড়তে পারেন: উল্টো পথে গাড়ি: প্রভাবশালীদের কাছে অসহায় পুলিশ
রাজধানীর মিরপুরে একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছেন কয়েকজন নারী। কেউ বালি, কেউ ইট ঝুড়িতে করে বহন করছেন। তাদের একজন রাবেয়া আক্তার। নিজের জীবনযুদ্ধ বিষয়ে তিনি বলেন, সকালে ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর গুছিয়ে, রান্না সেরে বের হতে হয়। এরপর অপেক্ষা করতে হয় কাজের জন্য। অনেক সময় ঠিকাদাররা নারী বলে কাজে নিতে চান না। কিন্তু একদিন কাজ না করলে তো সংসার চলবে না। ক্লান্তিহীনভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ঘরে ফিরেও আবার সংসার সামলাতে হয় তাদের। নারী-পুরুষ একই কাজ করলেও নারীদের বেলায় মুজুরি কম। বেশির ভাগ জায়গায় পুরুষের মজুরির অর্ধেক পাই। কাউকে কিছু বলার নেই। প্রতিবাদ কার কাছে করব, তখন তো কেউ কাজও দেবে না। প্রধানমন্ত্রী সবার সমস্যা সমাধান করে দেন, আমাদের মতো গরিবের জন্য যদি কিছু করেন।
রাবেয়ার সঙ্গেই কাজ করছেন আমিনা আক্তার। ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখে বললেন, কথা বলার সময় নেই। ঠিকাদার কাজ ছেড়ে কথা বলতে দেখলে বকবেন। অনুরোধের পর আমিনা আক্তার বললেন, দিন মুজুরের কথা আর কে শোনে? আমরা তো আর আন্দোলন করতে পারব না। তবে, প্রধানমন্ত্রী যদি সব মালিককে বলে দিতেন, তাহলে আমরা সমান মজুরি পেতাম।
সরকার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও নারীদের জন্য মজুরির সমতা নির্ধারণ করলে দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করেন ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের ডেপুটি পোগ্রাম ম্যানেজার নাজনীন কবির। তিনি বলেন, আগের চেয়ে শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বেড়েছে। তবে বৈষম্য দূর হয়নি। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের আসলে সংগঠিত হয়ে দাবি আদায়ে আন্দোলনের সুযোগ নেই। সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে সমাধানের। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও নারী শ্রমিকদের জন্য মজুরির সমতা নির্ধারণ করে দিলে বৈষম্য দূর হবে। নিশ্চিত হবে নারীর কাজের মর্যাদাও।
আরও পড়তে পারেন: পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সাক্ষ্য দিতে হবে না বিশ্বব্যাংককে
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শ্রমজীবী মানুষ বরাবরই নিপীড়িত। এরমধ্যে নারীরা বেশি বৈষম্যের শিকার। শ্রমজীবী মানুষদের নেই সামাজিক মর্যাদা, বিশ্রাম, নিরাপত্তার কর্মস্থল, পেশাগত নিরাপত্তা। বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীদের বছর-বছর বেতন-ভাতা বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। এক্ষেত্রে সরকারে উচিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা। শ্রম আইনে নারী-পুরুষ সবার মজুরি সমানের কথা থাকলেও তা মানেন না মালিক পক্ষ। এ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রমিক ঐক্যের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আলমগীর মজুমদার বলেন, শ্রমিকরা বরবরই বৈষম্যের শিকার হন। এরমধ্যে নারীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতনের শিকার হন। নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ জরুরি। শ্রম আইনের প্রতিফলন ঘটাতে সরকারের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। অপরাধী মালিকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
/এমএনএইচ/