বদরনেতা নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

মতিউর রহমান নিজামীএকাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এ রায় কার্যকর করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ তথ্য জানান।
এরপর ১২টা ২৬ মিনিটে কারগার থেকে বেরিয়ে এসে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির সাংবাদিকদের বলেন, ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।


গত বৃহস্পতিবার (০৫ মে) এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। অন্য তিন বিচারপতি হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এরপর রায়ের কপি কারাগারে যাওয়ার পর তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা জানতে চাওয়া হয়। মতিউর রহমান নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না জানালে ফাঁসি কার্যকরের পরবর্তী ধাপ শুরু হয়।
ফাঁসি কার্যকরের জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে জল্লাদ রাজুকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় মঙ্গলবার বিকেলে। এর মধ্যে সোমবার থেকে কয়েক ধাপে তার শারীরিক পরিস্থিতি পরীক্ষা করেন কারা চিকিৎসক।
নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেননি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়া হয়েছে। এরপরই সন্ধ্যা ৭টার পর নিজামীর সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাতের জন্য কারাগারে উপস্থিত হন তার পরিবারের সদস্যরা। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর তারা কারাফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন। একজন স্বজন জানান, নিজামী ভালো আছেন। এছাড়া তারা সাংবাদিকদের কাছে কিছু বলতে রাজি হননি। নিজামীর আইনজীবী বলেছেন, যদি কিছু বলার থাকে পরে বলা হবে।

নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) প্রমাণিত ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৪টিতে ফাঁসি ও ৪টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৩টিতে ফাঁসি ও ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। অন্য তিনটিতে চূড়ান্ত রায়ে দণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী, যার মধ্যে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ছিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ সব ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২৮ মে ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয়।

গত ২৯ মার্চ ৭০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনটি করেন নিজামীর আইনজীবীরা। এতে মোট ৪৬টি কারণ দেখিয়ে আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় বাতিল করে খালাস ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আরজি জানানো হয়।

গত ৩ ও ১০ এপ্রিল রিভিউ আবেদনটি কার্যতালিকায় এলেও আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনে দু’দফা পিছিয়ে যায় শুনানির দিন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ০৬ জানুয়ারি নিজামীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির একই আপিল বেঞ্চ।

গত ১৫ মার্চ আপিল মামলাটির ১৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে এ পর্যন্ত মোট পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন জামায়াতে ইসলামীর এবং একজন বিএনপির। প্রথম ফাঁসি হয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। এরপর ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২২ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়।

গোলাম আযমের পর ২০০০ সাল থেকে নিজামীই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। গত মার্চে ৭৩ বছর পূর্ণ করেন এই মানবতাবিরোধী অপরাধী।
পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত নিজামী মৃত্যুর আগেও তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেননি। বরং বিচার শুরুর প্রক্রিয়ার সময় তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বলে দাবি করেছিলেন।

জেইউ/ইউআই/এআরআর/সিএ/এজে