কোনও সাংসদ খোঁজ না নেওয়ায় আক্ষেপ

তাকে সবাই বলে ‘তারছেঁড়া মাস্টার’: সেলিম ওসমান

শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনায় নিজের অবস্থান ব্যক্ত করতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। এসময় তিনি দাবি করেছেন, ওই শিক্ষক মানসিক ভারসাম্যহীন এবং স্বেচ্ছায় কান ধরেছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে সেলিম ওসমান

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজিত হয়। এসময় শুরুতেই তিনি তার নিজের ব্যক্তিগত ও ওসমান পারিবারের সুনাম বর্ণনা করেন।

সেলিম ওসমান দাবি করেন, এ মাস্টারকে সবাই ‘তারছেঁড়া মাস্টার’ হিসেবেই জানে। পাশাপাশি শ্যামল কান্তি ভক্তকে আমার প্রয়াত বড় ভাই নাসিম ওসমান খুব স্নেহ করতেন। তার তিন মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় মেয়েকে নাসিম ওসমান একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি দিয়েছিলেন। প্রধান শিক্ষক শ্যামল দুই বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছিল। এ ধরনের একজন ব্যক্তিকে কিভাবে প্রধান শিক্ষক বানানো হয়েছিল সেটাও আমার বোধগম্য না। ইতোমধ্যে আমার পূজা উদযাপন পরিষদের লোকজন বিষয়টি তদন্ত করেছে।

সেলিম ওসমান আরও বলেন, ‘শ্যামল কান্তি ভক্তের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা হচ্ছে। সে ভারতের ভেলোরে চিকিৎসার জন্য যেতে চেয়েছে, আমি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। একটু আগেও আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছে।’

সংসদে সহকর্মীদের প্রতি ওসমানের আক্ষেপ

সেলিম ওসমান বলেন, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল অথচ আমার সংসদের কোনও বন্ধুই আমাকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানতে চাননি। কোনও আলোচনা করেননি। তারা তো আমাকে ডাকতে পারতেন, শাসন করতে পারতেন। কিন্তু সেটি তারা করলেন না।

এ নিয়ে একদিন আগে জাতীয় সংসদের লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য এম আউয়াল এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ১৪ দলের সভায়ও এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। আমরাও বিব্রত। এ ধরনের আচরণ একজন এমপি করতে পারেন না। তিনি বলেন, ওই সময়ের ঘটনা শান্ত রাখার জন্য আরও নানা পথ ছিল। কিন্তু কোনও পথ না বেছে তিনি শিক্ষককে শাস্তি দিলেন। শাস্তি তো হয় প্রমাণের পর। প্রমাণিত না হলে যেকোনও মানুষের সঙ্গে এমন করা সঠিক না।

ঘটনা বিবরণ দিলেন সেলিম, স্বেচ্ছায় কান ধরেন শ্যামল কান্তি

শুক্রবারের ঘটনা প্রসঙ্গে সেলিম ওসমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার আমার থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ছিল। কিন্ত শুক্রবার বন্দরে একটি ফুটবল খেলার অনুষ্ঠান আমাকে উদ্বোধন করতে হবে এলাকাবাসীর এমন চাপে আমি সিডিউল পরিবর্তন করে রবিবার যাওয়ার তারিখ ঠিক করি। শুক্রবার সকাল ১০টায় ওই স্কুলের হিসেব নিকেশ নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়েছিল। ওই স্কুলে ইতোমধ্যে আমার ব্যক্তিগত তহবিল হতে ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। স্কুলের একটি দেয়াল নির্মাণ ও একটি পুকুর ভরাট নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির ওপর স্থানীয়দের ক্ষোভ ছিল। কারণ জলাশয় ভরাট করতে হলে চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের অনুমতি প্রয়োজন হয়। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় স্কুল শিক্ষককে গণপিটুনি দিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। পরে পুলিশ এসে প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করে স্কুলের একটি কক্ষে তাদের জিম্মায় রাখে। পুলিশ ও স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। দুপুর ১২টায় আমাকে ফোন করা হয়। তখন আমি স্থানীয়দের জানাই, তোমরা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারবে কিনা। উত্তরে তারা হ্যাঁ জানায়।

আরও পড়তে পারেন:

ধর্ম নিয়ে শ্যামল কান্তির কটূক্তির সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটিশিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ

তিনি আরও বলেন, আমি জুমা’র নামাজের পর রওনা দিয়ে বিকেল ৪টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছাই। তখন সেখানে গিয়ে দেখি ৫ হাজার এর মতো লোক বৃষ্টিতে ভিজে সেখানে উপস্থিত রয়েছে। তাদের মধ্যে ৮শ’ থেকে ১ হাজার নারীও ছিল। অনেকেই সেদিন দুপুরে নামাজ পড়তে যায় নাই। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর লোকজন আমাকে বলে ‘এমপি সাহেব শিক্ষক যেন ঘর থেকে বের হতে না পারে। মাস্টারকে আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। আমরা তাকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলবো। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে আমি বদ্ধঘরে থাকা হেড মাস্টারের কাছে কারণ জানতে চাই এবং ধর্ম নিয়ে কোনও কটূক্তি করেছে কী না সেটা জানতে চাই। উত্তরে প্রধান শিক্ষক আমাকে বলেন, ‘হয়তো আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমার মাথা নষ্ট। কটূক্তি করলেও করতে পারি। আমি তিন কন্যার বাবা, আমি একজন কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা। আপনি আমাকে রক্ষা করেন।’ তখন তাকে আমি জিজ্ঞেস করি আপনি এখন কী করবেন, তখন প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছায় কানে ধরে উঠবস করার কথা স্বীকার করেন। পরে আমি তাকে ঘর থেকে বের করে আনি। তখন হেড মাস্টার কানে ধরে উঠ বস করে। হ্যাঁ, তখন আমি এলাকাবাসীর জন্য পরিস্থিতি সামাল দিতে আঙুল দিয়ে ওঠবস করতে বলেছিলাম।

সেলিম ওসমান বলেন, ‘ওই সময়ে সেটা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। আমি যাওয়ার আগে তাকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছিল। তার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। ওই সময়ে আমার আর কোনও পথখোলা ছিল না। কারণ, আমি একজন মুসলমান, আমি একজন ঈমানদার। আমার আল্লাহকে কেউ কটূক্তি করবে আর আমি সহ্য করবো সেটাও হবে না। একজন মুসলমান হিসেবে আমি একজন কটূক্তিকারীকে শাস্তি দিয়েছি। আমি কোনও শিক্ষককে শাস্তি দেই নাই। তবে ঘটনার ভিডিও ও অন্য চিত্র যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে কিছু কাটছাট করা হয়েছে। কারণ যখন মাস্টারকে কান ধরে উঠবস করা হয় তখন এলাকার লোকজন ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেয়। অথচ সেখানে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান জুড়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর আমি প্রধান শিক্ষককে পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। মাস্টার এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে অথচ কেউ কোনও খবর নিল না তার খরচ কে চালাচ্ছে। একটি মহল ঘটনার পর থেকেই ষড়যন্ত্র করে আসছে বলেও দাবি করেন সেলিম ওসমান। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত এমপি। সবাই তো আর আমাকে ভোট দেয় নাই।’

আমার লোকজন কি হাতে চুড়ি পড়ে আছে?

নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক অপমানের ঘটনায় নানা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থেকে তাকে গণধোলাই দেওয়ার প্রসঙ্গে সেলিম ওসমান বলেন, ‘আমার লোকজন কি হাতে চুড়ি পড়ে আছে?’ প্রশ্ন ছুড়তেই সংবাদ সম্মেলনে থাকা সেলিম ওসমানের অনুসারীরা চিৎকার করে উঠেন ‘আমরা আছি, শুধু অর্ডার দেন।’ তখন সেলিম ওসমান পাল্টা উত্তরে বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করতে চাই না। বন্দরের ঘটনার কারণে যদি আমার ফাঁসিও হয় তাহলে কেউ কোনও প্রতিবাদ করবে না। যে শাস্তি হউক আমি মাথা পেতে নিব।’

নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড মিলনায়তনের তৃতীয় তলায় সংবাদ সম্মেলনে সেলিম ওসমানের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এর সহ সভাপতি জিএম ফারুক, বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লিটন সাহা, বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলম সজল, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মঞ্জুরুল হক, আবদুস সোবহান, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহা, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান মিঞা, বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল প্রমুখ।

/এনএস/টিএন/