বাবা ও নজরুলের সান্নিধ্যে নূরী’র বেগম সম্পাদক হয়ে ওঠা

নূরজাহান বেগমসামাজিক বাস্তবতার মধ্যে শত বাধা পেরিয়ে সাংবাদিকতা করা এবং সেটাকে প্রায় ৭০ বছর টেনে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা কোথায় পেয়েছিনে নূরজাহান বেগম। প্রায়ই তাকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কীভাবে ছোট্ট নূরী হয়ে উঠলেন একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সুনামখ্যাত সম্পাদক। নূরজাহান এককথায় স্বীকার করে গেছেন, ‘বাবার হাত ধরে না এগুলে এতো সহজ হতো না পথটা। আর তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব ছিল তার ওপর অনেকটাই।’
‘লেখাপড়ার বিষয়ে আমার বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন খুবই সচেতন ছিলেন। মূলত ছোটবেলা থেকেই বাবার সহায়তায় লেখালেখিতে আগ্রহী হয়ে উঠি। বাবা ১৯২৭ সালের দিকে ‘সওগাত’-এ ‘জানানামহল’ নামে প্রথম নারীদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন।তারপর ১৯৩০ সালে ‘সওগাত’-এ প্রথম মেয়েদের ছবি ও লেখা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করলেন। তারপর থেকে 'সওগাত' ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বছরে একটা করে মহিলা সংখ্যা প্রকাশ করে। এসব প্রকাশনার সঙ্গে সব সময়ই বাবা আমাকে তার পাশে রেখেছেন।’ বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম নিজের গণ্ডি থেকে অন্যরকমভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রায়শ বলতেন, ‘বাবার হাত ধরে সাংবাদিকতায় আসার কারণে অনেক কিছু সহজ হয়েছিল।’
নূরজাহান বেগম বলেন, সে সময় সওগাত অফিসের দোতলায় একটি রুমের মেঝেতে চাদর বিছানো থাকত। সেই চাদরের ওপর প্রতিদিন বিকালে আসর বসতো। আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দিন (আজাদ পত্রিকার সম্পাদক), আবু লোহানী, আবুল ফজল, ইব্রাহিম খার মতো অনেক বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিকরা। ওই আসরে চা পরিবেশন করার দায়িত্ব ছিল ছোট নূরজাহান বেগমের।

বাবা এবং তার সহযোদ্ধারা সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে যেমন আলাপ-আলোচনা করতেন, তেমনি হাসি-গল্পে আসরটি মাতিয়ে রাখতেন।ছোট থাকায় সব আলাপ না বুঝলেও ভাল লাগা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন। এই দাঁড়িয়ে থাকা ও শোনার মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক জগতের দিকে ধাবিত হতে থাকা। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাসিরউদ্দিন প্রচুর দেশি-বিদেশি বই আনতেন।

আরও পড়ুন: নূরজাহান বেগম‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগম আর নেই

কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। কারণ দাদীর নামে নাম এই ছোট্ট নূরী এদের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠে, একসময় হয়ে উঠলেন একটি পত্রিকার দায়িত্ববান সম্পাদক, নারী সাংবাদিকতার পথিকৃত। নূরজাহান বলতেন, ছোট ছোট পা ফেলে আমি বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতাম। তাদের মধ্যে বলিষ্ঠ গলায় কথা বলতেন যিনি তিনিই কাজী নজরুল ইসলাম। আমাকে উনি বড় হয়েও দেখেছেন। কিন্তু ছোট থেকে তাদের কথা শুনে, তাদের দেখে বেড়ে ওঠার পুরো প্রভাবই ছিল আমার কাজের মধ্যে।

যখন ছোট নূরী বেড়ে উঠছেন সেসময় নজরুলের একটা স্মৃতি প্রায়ই অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন নূরজাহান বেগম। ‘কবি ডেকে উঠলেন, ‘তুই দিল্লি যাবি? দিল্লি কতভাবে যাওয়া যায়, তাই না? রেলগাড়িতে যেতে পারিস, বাসে চড়ে বা উড়োজাহাজে। গন্তব্য কিন্তু একটাই। জীবনের গন্তব্যও তেমনই।ঠিক করে নিতে হবে কীভাবে যাবি। আদরের নূরী সেদিনই বুঝে যান, কখনও কখনও কেবল ঘর থেকে বের হওয়াটাই জরুরি। কীভাবে বের হলেন, আপনার রান্নাঘর আর সন্তান প্রতিপালনের বাইরে কাজ আছে, সেটা জানতে বের হতেই হবে। আর সে কাজটা কীভাবে করবেন সেটা আপনার বিবেচনা।

আরও পড়ুন: নূরজাহান বেগমসেই চেনা অচেনা ‘বেগম’

শুরুর সময়টা কীভাবে বাবা সহায়তা করেছিলেন বলতে গিয়ে নূরজাহানের নিজের বক্তব্য ছিলো পুরোটাই আত্মসমর্পনের। তিনি বলেছেন, নানা সময়, বাবার উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বেগম'। সম্পাদক বেগম সুফিয়া কামাল,ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমি। স্থির হয় ‘বেগম'-এর প্রচ্ছদে মহিলাদের ছবি ছাপা হবে। হলোও তাই। পত্রিকার বিষয় ছিল নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামগঞ্জের নির্যাতিত মহিলাদের চিত্র, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের লেখা চিঠি এবং মনীষীদের বাণী।' মনে রাখতে হবে বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন তখন বিখ্যাত মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

বাবার হাত ধরে শুরু করলেও পরের রাস্তাটুকু তিনি নিজ যোগ্যতায় চালিয়ে নিয়েছেন। নারী সাংবাদিক বললে এ বাংলায় নূরজাহান বেগম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে জন্ম নেওয়া নূরী নিজের কাজের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন সম্পাদক নূরজাহান বেগম।

এপিএইচ/