বাবাদের গল্প

মা-বাবাই সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল। তাদের সঙ্গে রোজকার আদর আহ্লাদে হাজারও স্মৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা। আজ বাবা দিবস। আর তাই সন্তানরা যার যার গল্প হাজির করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। কেউ লিখছেন বাবার সঙ্গে খুনসুটির কথা, কেউ লিখছেন বাবা হারানোর ব্যথার কথা, কেউ লিখছেন পাহাড়ের মতো স্থির আর দায়িত্ব মাথায় নিয়ে বাবা কিভাবে নিজের জন্য কিছু না ভেবে সন্তানের জন্য সব করেন। অনেকে লিখেছেন বাবার কাছ থেকে কিভাবে ধৈর্যশীল আর আত্মবিশ্বাসী হতে শিখেছেন, বাবার ভালোবাসা, শখ কিংবা অভ্যাস নিজের হয়ে গেছে, কেউ বলতে চেয়েছেন তার জীবনে মায়ের চেয়ে বাবার প্রভাবই বেশি।

আলোকচিত্রী মুনিরা মোর্শেদ মুন্নী লিখেছেন, বাবার হাত ধরেই ছোটবেলায় প্রথম দেখেছি সমুদ্র, সেই থেকে সমুদ্র সবুজ আমার প্রিয় রং। বাবার হাত ধরেই ছোটবেলায় প্রথম উঠেছিলাম সিতাকুণ্ড পাহাডের চূডায়। সেই থেকে পাহাড়ের গাম্ভীর্য আমাকে বার বার পাহাড়ের কাছে নিয়ে যায়। সমুদ্র ছাড়িয়ে পাহাড় প্রিয় হয়ে ওঠে। এই ছোট ছোট বাক্যে অনুভূতির পাহাড় জমেছে যেন। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সাধারণ চাকুরে একবার করে স্ট্যাটাসে এসে ছোট বড় দুঃখ বেদনা আনন্দ উল্লাস লিখে যাচ্ছেন বাবাকে নিয়ে, যার অনেকটাই হয়তো বাবাদের নজরেও আসবে না। এটা কেবল নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা, নিজের অনুভূতিতে শান দেওয়া। বাবাকে নিয়ে তেমনই কিছু গল্প এখানে তুলে ধরা হলো:

বৃত্বা রায় দীপাবৃত্বা রায় দীপা
‘বাবাদের শার্টগুলো বেশিরভাগ সময় মাদের শাড়ি থেকে দামি হয় না, বাবাদের ওয়ারড্রব ভর্তি শার্ট-প্যান্ট থাকে না। বাবাদের জুতা চলে বছরের পর বছর, মোবাইলটা একেবারে নষ্ট না হলে বদলান না, ঘড়িটা বৃদ্ধ হয়, তবুও হাতেই থাকে। একা খেতে হলে সবচেয়ে সস্তা হোটেল খোঁজেন, একা কোথাও গেলে বাসে চড়েন। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সঞ্চয় করেন। অথচ স্ত্রী-সন্তানকে সাধ্যের সব চেয়ে দামি জিনিসগুলো কিনে দেন। বাবারা একান্ত বাধ্য না হলে কখনও না বলেন না। নিজের জন্য সবচেয়ে কৃপণ বাবাটা তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি বেহিসাবি। বেশিরভাগ বাবাই ভালোবাসি শব্দটা বলতে জানেন না, করতে জানেন। তারা আজীবন তাদের ভাগের বিলাসিতার ভাগ দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবেসে যান... পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ পুরুষ আছেন, অসংখ্য খারাপ জন্মদাতাও আছেন। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই...।’

আরাফাত সিদ্দিকআরাফাত সিদ্দিক
গত সপ্তাহে রাজশাহীর বাসায় গিয়েছিলাম। আব্বা-আম্মা থাকেন ওখানে। খেয়াল করলাম, আব্বা একটি হাফহাতা শার্ট গায়ে দিয়েছেন যেটা আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় পরতাম। আমি অবাক হলাম ওই শার্টটা এখনও টিকে আছে! এই শার্টের কলার ছিঁড়ে গিয়েছিলো বলে তা বাতিল করে দিয়েছিলাম।
আব্বাকে বললাম, তুমি কি এটা আরেকটা কিনেছো, এর কলারটা তো ছেঁড়া ছিলো? আব্বা হেসে বললেন, না তোমার ওটাই এটা। তাহলে এর কলার ঠিক হলো কিভাবে!
আম্মা জানালেন, 'তোর বাপকে নিয়ে পারি না, দর্জির কাছ থেকে কলারটা উল্টে নিয়ে ওটা ঠিক করে আনছে। এতো বলি অন্য জামা পরতে, কিন্তু পরে না।'
গতমাসে আব্বা সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। আজীবন দেখলাম, নিজের চাহিদা বলে তার কিছুই নেই। কিন্তু আমার কিছু লাগলে তার টাকার অভাব নাই। ভাই-বোনের কিছু লাগলে যে করেই হোক জোগাড় করেন।

আব্বার কী ভালো শার্ট নেই! আছে, আমি ও আমার বোন তাকে বেশ কয়েকটি কিনে দিয়েছি। তিনি পরেন না। নতুন জুতা দিয়েছি, তিনি পুরনোটাই পায়ে দেন। কৈফিয়ত চাইলেই বলেন, ‘চলছে তো সমস্যা কি?’ প্রতিদিন রাতে খাবার আগে তিনি আমাকে নিয়ম করে ফোন দেন। হ্যাঁ প্রতিদিন, কোনও মিস নাই তার! আমি প্রতিদিন ওই ফোনটার অপেক্ষায় থাকি।

জেসমিন পাঁপড়িজেসমিন পাঁপড়ি
সেবারও কাজে ক’দিনের জন্য বাড়ির বাইরে আব্বু। দুপুরে গোসল শেষ করানোর পর আম্মু আমার মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে। (এক হাতে দু’গাল টিপে ধরে আারেক হাতে চিরুনি নিয়ে কি যুদ্ধই না সে করত) শেষ হতেই আমার চিৎকার- হয়নি। এভাবে না। আবার দাও। ... আম্মু আবার চুল আঁচড়ে দিল। কিন্তু প্রথমবারের চেয়ে দ্বিগুণ তেজে আবার চিৎকার। হয়নি...
এবার আম্মুর সব চেষ্টাকে পরাস্ত করে সদ্য গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরানো আামি নাগিন ড্যান্স দিতে দিতে মাটিতে গড়াগড়ি আর কান্নাকাটি শুরু করলাম। কথা একটাই- চুল আঁচড়ানো কেন আাব্বুর মতো হলো না। আব্বু যেভাবে চুল আঁচড়ায়, আমার চুল সেভাবেই আঁচড়ে দিতে হবে।
আম্মুর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার পালা- খেলাম ধুম পিটুনি। এরপর কান্নারত অবস্থায় আবার গোসল, আবার চুল আঁচড়ানো। ততক্ষণে কান্নার ঢেউ কিছুটা থেমে এলেও ফোঁপাতে ফোঁপাতে আবারও দাবি চুল আঁচড়ানো আব্বুর মতো হওয়া চাই।
এবার আম্মু বুঝল- আব্বুকে মনে পড়ছে আমার। কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাকে বুকের মধ্যে নিয়ে আম্মুর সান্ত্বনা- শিগগির বাড়ি আসবে আব্বু।...

আজও প্রতি মুহূর্তে আব্বুর মতো হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি। যা এই একজীবনে হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। আর প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মিস করি আপনাকে। ভালবাসি আব্বু।

কাবেরী গায়েনকাবেরী গায়েন
কী কর মা?
- পড়ি।
-কী পড়? ইংরেজি? ঠিকাছে। বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্তু তোমার ফার্স্ট হইতে হবে, বোর্ডে।
-বাবা! থামবেন?
-ক্যান? খারাপ কিছু বলছি? শুধু অংকে একশো যদি পাও, তা তো তুমি পাবাই, আর ইংরেজিতে ৯৭/৯৮ হইলেই হবে, এর নিচে পাওয়ার কোনও কারণ তোমার নাই, আর বাংলা? তোমার চেয়ে ভালো আর কে লিখবে? আমি তো বুঝি না, এর মধ্যে ভুলটা আমি কী বলছি?
- বাবা, আপনি যাবেন?
- না, তুমি এখন পড়, আমি এই বিছানায় একটু শুয়ে থাকি।
- বাবা, আমার ডিস্টার্ব হয়।
- আমি আর কিচ্ছু বলবো না, একটু শুয়ে থাকবো এইখানে। তোমরা যখন পড়, সেইটা দেখতেই যা আনন্দ।
রাত বাড়ে। বিছানায় যাওয়ার আগে এক বাবা সব ছেলেমেয়ের পড়া তদারকি করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান। ভালো চাকরি করেন, অথচ আর্থিক সচ্ছলতা তেমন নেই। ঘরে টেলিভিশন নেই, কোনও বিনোদনের উপকরণ নেই। কিন্তু প্রচুর বই আছে, সামর্থের সেরা খাবার আছে, আর আছে আসবাবহীন বড় বাসা। রাতে তার খুব ভালো ঘুম হয়। এতো ভালো যে রাতে আর স্বপ্ন দেখা হয় না। অসুবিধা নেই, সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তো যতক্ষণ জেগে থাকেন। এইসব বাবাদের স্বপ্নে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো শিক্ষিত হয়েছিলো। তাদের মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোকে জীবনের সার ভেবেছিলো। এখনও কি বাবারা এমনই?

আতিকা রোমাআতিকা রোমা
আমার বাবার পরিচিতজনরা আমাকে একবার দেখেই বলে দিতে পারে আমি আমার বাবার মেয়ে। আমাদের নাকি চেহারায় খুব মিল। হয়তো মিল আছে। বাবাকে বুঝতে বুঝতেই তিনি চলে গেছেন, আর বোঝা হয়ে ওঠেনি। তবে ‘ছেড়ে আসা মাটি’ নামের একটি বই পড়ে বার বার বাবাকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমার বাবার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভারতের জলপাইগুড়িতে। এরপর ব্যাংকের চাকরি সূত্রে বিভিন্ন দেশে থেকে অনেক পরে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস। বাবা বলত তার কোনও দেশ নেই। তার কোনও মাটি নেই। তার কোনও জাতীয় সংগীত নেই। এরকম শক্ত কথার মানে আমি বুঝতাম না তখন, এখন বুঝি একজন মানুষকে তার মাটি ছাড়া করলে শিকড়ে কেমন ব্যথা হয়। যেখানেই থেকো বাবা, ভালো থেকো এই জেনে যে তোমার সন্তানের একটি স্থায়ী মাটি এবং একটি জাতীয় সংগীত হয়েছে।

বিল্লাহ মাসুমবিল্লাহ মাসুম
১৭ জুন ২০১২ আমার ফেসবুক দেয়ালে লিখি:
আব্বার ওপর আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল সেবার। রোজার কাল। এক সন্ধ্যায় ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফিরছি। গাঁটের পুঁজি পরাজিত দলের হয়ে অপরাজিত ২৩ রান। রিভার্স সুইপ করে একটা চারের মারের তৃপ্তি আমার অভিব্যক্তিতে তখনও সতেজ। কিন্তু সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকার অপরাধে আব্বার চ্যাঁচানি দেওয়ার শঙ্কা চেহারাকে পাংশু করে দিচ্ছে। বাড়িতে ঢোকার নিরাপদ করিডোর- পুকুরপাড়ের পথ দিয়ে তস্করের মতো প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু হায়! অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। আব্বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে। না, আব্বা রাগ করলেন না, কিন্তু স্লোআর কাটার দিলেন: ‘তুমি ক্রিকেট খেলতে পারোনি, ক্রিকেট তোমাকে খেলছে।’ এটা ডিফেন্স করার শক্তি আমার ছিলো না। আমি আর কখনও ক্রিকেট খেলিনি... আমি নিজেও জানতাম ক্রিকেটটা আমি ডাঙ্গুলির চেয়ে বেশি ভালো কিছু খেলি না।
আব্বার কথার প্রতিবাদে আমি পরের পড়াশুনো ভালোই করেছিলাম... ভালো ছাত্র গোছের কিছু তকমাও জুটেছিলো ভার্সিটি জীবনে... তারপর তো আরও অনেক বছর কেটে গেল... বহুত আনন্দ বেদনার উপলন্ধি আব্বাকে বলা হয়নি। আজ বাবা দিবসেও ফোন করা হয়নি। প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত মাস্টার আমার আব্বা ইন্টারনেট বোঝেন না... বয়স হয়েছে... এখন শুধু বসে আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রহর গোনেন... শহরের যান্ত্রিকতায় খোঁজ নেওয়া হয় না নিয়মিত... মাঝে মাঝে কচুরিপানার মতো শহরের মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে হাঁটি, আলগোছে চোখের পাতা ভিজে ওঠে আব্বার কথা মনে করে। ... একজন ধার্মিক মনের মানুষ হয়েও তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হওয়া যায়... আমার বাপ শিখিয়েছেন, কিভাবে অনেক দুঃখের মধ্যেও হাসতে জানতে হয়...

বাবা বললেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।’ ...কাল বাড়ির টানে, নাড়ির টানে, একজন জীবন দার্শনিক স্কুল মাস্টার আমার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি... জানি আসার সময় আব্বা আগের যে কোনও সময় থেকে বেশি জড়িয়ে ধরবেন, এই ভেবে যে এইটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা।

১৯ জুন ২০১৬
আব্বা চলে যান আরও ছ'মাস পরে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। মাঝে মাঝে মনে হয় কেনও আরও বেশিবার ফোন দিলাম না আব্বাকে। কেনও আরও বেশিবার বাড়ি বেড়াতে গেলাম না। কেনও তার কণ্ঠস্বরটি কোনও এক রেকর্ডারে ধরে রাখলাম না! আজও তারাবিহতে বসে আব্বার দরাজ গলার মোনাজাত শুনি... ‘ইয়া মুজিরু ইয়া মুজিরু, বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।’ উচ্চারণগুলো অদ্ভুত এক মুগ্ধতা দিয়ে পরবর্তী রাকআতে যাওয়ার প্রেরণা যুগাতো...

রাজীব নূর খানরাজীব নূর খান
অনেক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল-
গ্রাম থেকে আমার মামা অনেকগুলো ডাব এনেছেন। কেউ ডাব কাটতে জানে না। প্রায় এক সপ্তাহ ডাবগুলো মাটিতে পড়ে আছে। আমি মাকে বলেছিলাম দোকান থেকে ডাবগুলো কেটে আনব। মা বলল- দোকানে নিয়ে গিয়ে ডাব কাটতে হবে না। আমিই কত্ত পারি।
সকাল দশটা। আমি বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছি। মা চিৎকার করে আমাকে ডাকলেন। দৌড়ে মার কাছে গিয়ে দেখি, বটি দিতে ডাব কাটতে গিয়ে মা তার হাতের একটা আঙুল কেটে ফেলেছে। আঙুলটা পুরোপুরি কেটে পড়ে যায়নি একটুখানি ঝুলে ছিল।

এই সময় আমি ছাড়া বাসায় আর কেউ ছিল না। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। মাকে নিয়ে গেলাম বাসার কাছে এক হাসপাতালে। হাসপাতালের নাম ছিল ‘নিউ এরা’। তারা তুলা দিয়ে মার আঙুল পেঁচিয়ে বলল- এইটা আমরা পারব না। তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিক্যালে যান। খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তা না হলে আঙুলটা বাঁচানো যাবে না। সেদিন রিকশা করে ঢাকা মেডিক্যালে যেতে সময় লেগেছিল ২ ঘণ্টা।

গিয়ে দেখি ঢাকা মেডিক্যালের অবস্থা ভয়াবহ। নোংরা পরিবেশ। আর দালাল দিয়ে ভরা এবং নার্সদের ব্যবহার অতি জঘন্য। যাই হোক, ঢাকা মেডিক্যালেও মার চিকিৎসা হলো না। তারা যেতে বলল- পঙ্গু হাসপাতালে। পঙ্গু হাসপাতালে যেতে সময় লাগল আরও ২ ঘণ্টা।

পঙ্গু হাসপালাতের অবস্থাও ঢাকা মেডিক্যালের মতো। বিশ্রি এবং নোংরা। সেখানে দালালদের সঙ্গে কথা না বলে উপায় নেই। হাসপাতালের একজন ডাক্তারের চেয়ে দালালের ক্ষমতা বেশি।
পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বলা হলো- এক্স-রে করতে হবে। তারপর চিকিৎসা হবে। এক্স-রে করতে গিয়ে একজন দালাল বলল- আমাকে দুই’শ টাকা দেন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি এক্স-রে করতে গেলে বলবে, মেশিন নষ্ট আজ এক্স-রে হবে না।

সকাল দশটার ঘটনা, এখন বিকেল চারটা। আমি ছোট মানুষ, তারপরও আমার খুব রাগ লাগছিল। আমার পকেট ভর্তি টাকা নেই যে দালালদের দিয়ে দেব। মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। খুব অসহায় লাগছিল। আমি এখন মাকে নিয়ে কী করবো?

হঠাৎ মনে হলো, আমি এত সব চিন্তা করছি কেন! আমার আছে একজন সুপারম্যান। তাকে খবর দিলেই সে নিমিষে সব সমাধান করে দেবে। প্রমাণিত। সুপারম্যান হলো আমার পিতাজি।

তখন মোবাইল ছিল না। আব্বাকে টিঅ্যান্ডটিতে ফোন করলাম। ফোন করার কিছুক্ষণ পরেই আব্বা চলে এলো। আব্বা হাসপাতালে পা দেওয়া মাত্র- যেন হাসপাতালটি কেঁপে উঠল। ৫ মিনিটের মধ্যে আব্বা মার সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো!

বর্না তারানাবর্ণা তারানা
আমার আব্বু। আমাদের আব্বু। অনেক মেয়ের মতো আমার ছোটোবেলা, মাঝারি বেলার নায়ক আব্বু। ছোটবেলা থেকে সবচে সুন্দর উপহারগুলো পেয়েছি আব্বুর কাছ থেকে। একেবারেই অনকমন। দামি নয়, অদ্বিতীয়। সবাই সেগুলোর এতো প্রশংসা করতো, যতদিন অক্ষত থাকতো আনন্দে কাটতো। জামা জুতা স্কুল ব্যাগ সব অন্যদের চেয়ে আলাদা। খাতা বাঁধাই করা, ছেঁড়া বই জোড়া দেওয়া, স্যান্ডেলের ফিতা লাগানো, স্যান্ডেল সেলাই, ওয়ালমেটের ডিজাইন সংশোধন, বাড়ির বাইরে যাওয়া শুরু হলে ব্যাগ গোছানো- শিখেছি আব্বুর কাছ থেকেই। যে কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গেলে আগে আব্বুর সামনে রিহার্সেল দিতে হতো।
একবার কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম প্যারা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর আর চেষ্টা না করে চলে আসতে যাব অমনি বিচারক আবার আমাকে সুযোগ দিলেন। বাসায় এসে আব্বুকে বললাম, আমি বলতে পারিনি। আব্বু বললো, সকালেও তো পুরোটা বলে গেলে- অনেক ভালো হয়েছে। ওখানে বলতে পারোনি তাতে কি! তবে ওরা যখন পুরোটা শুনেছে পুরস্কার তুমি পাবেই। পেয়েছি ১ম পুরস্কার। তখনই শিখেছি- ‘আত্মবিশ্বাস’।
শুরুতে কিছু কাজে সাহায্য করতো আব্বু- একটু বড় হবার পর বলতে শুরু করলো- নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, ছেলে হলে যা করতো তাইই। বই-খাতা কেনা, সত্যায়িত করতে যাওয়া, ফটোকপি করা, ভর্তির সব কাজ, ঠিক ছেলের মতো। একা একা করেছি। বন্ধুদেরগুলোও করে দিয়েছি, সঙ্গে থেকেছি। এই আমার- নিজেকে তৈরি করতে, চিনতে সাহায্য করেছে আব্বু। শুধু তার জন্যই আমি মাস্টার্স শেষ করতে পেরেছি কোনও বাধা ছাড়াই (পড়তে পড়তে বিয়ে/চাকরি করতে হয়নি)। হিসাব করে টাকা খরচ করা আর জায়গা মতো বেহিসাবি হওয়া। সবক্ষেত্রে সৎ থাকার আনন্দ। আব্বুর কাছেই শিখেছি- সৌন্দর্য নয়, গুনই মানুষের পরিচয়। নাক বোঁচা, কম উচ্চতার মেয়েকে নিয়ে তার কোনও অপূর্ণতা নেই। আমার চুল কেটে দিতো আব্বু। শুনে বন্ধুরা অবাক হতো।

সারাক্ষণ হেসে হেসে কথা বলা আব্বুর প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে বড় হয়েছি। রাগ অসীম। পেয়েছি পুরোটা। আমার কাজিনরা সবাই ভয় পেত আব্বুকে। এই প্রতাপশালী মানুষটাই একটুখানি গা গরম হলেই ভয় পেয়ে যেতো। সবাইকে অস্থির করে তুলতো। একেবারেই পুরুষতান্ত্রিক আব্বু আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নমনীয় হয়েছে। নিজেকে বদলেছে অনেকটাই। আম্মুকে ছোট বড় সব কাজে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছে। আমার ভালোবাসা আরও বেড়েছে। ভীষণ বড় বড় অপরাধ ক্ষমা করে কাছে টেনে নিয়েছে বারবার। আমাকে আমার মতো মেনে নিয়েই ভালোবেসেছে। সুপারম্যান বাবা নয়, আমার মানুষ আব্বু- তোমার দোষ-ক্রুটি-ভালো-মন্দ, সবকিছু নিয়েই আমার ভালোবাসা।

এজে/