গুলশানে হোটেল আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলাকারীরা ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু ফারাজ তার বন্ধুদের ছেড়ে চলে আসতে চাননি। ফলে তাকেও মেরে ফেলা হয়। ফারাজের এই সিদ্ধান্তে একইসঙ্গে রয়েছে কান্না ও গর্ব। তার স্বজনরা বলছেন, ‘প্রাউড অব ইউ বাবা’। কেউ বলছেন, ‘জীবন দিয়ে দিস, তাও জঙ্গি হইস না’।
গত শুক্রবার গুলশানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ফারাজ হোসেন একং অবিন্তা কবির।ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি আর অবিন্তা এলিগেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহমেদের একমাত্র কন্যা। তারা দুজনই যুক্তরাজ্যের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। আর তাদের আরেক বন্ধু ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈন ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
অবিন্তা, ফারাজ এবং তারুশি তিন বন্ধু মিলে সেদিন তারা একইসঙ্গে রাতে খেতে যায় হলি আর্টিজান বেকারিতে।সঙ্গে ছিল আরেক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বাংলাদেশি বন্ধু।তিন বন্ধু মারা গেলেও নর্থ সাউথে পড়া বন্ধুটি নিরাপদে আছেন বলেই জানিয়েছে বিশ্বস্ত সূত্র।
এদিকে এলিগেন্ট গ্রুপের এজিএম মো. লিয়াকত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ওরা তিনজন বন্ধু ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করতো একসঙ্গে। ঈদ করতে দেশে এসে এভাবে লাশ হবে সেটা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।
কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্র সেদিন রাতের প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশি কাউকে মারবেন না বলে জানিয়েছিলেন জঙ্গিরা। সে হিসেবে তারা ফারাজকে সেদিন প্রথমে ছেড়েও দিয়েছিলেন, কিন্তু ফারাজ তার বন্ধুদের রেখে ওখান থেকে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে প্রাণ দিতে হয় তাকে ও সঙ্গে থাকা ভারতীয় নাগরিক তারিশি ও অবিন্তাকে।
অপরদিকে ফারাজকে বিশ্বাসী তরুণ হিসেবে স্মরণ করেছেন সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ফারাজ বিশ্বাসী তরুণ। ঘাতকেরা তাকে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু ও তার দুই বন্ধুকে ছাড়া যেতে রাজি হয়নি। মহাপ্রাণ ছেলেটি বাংলাদেশি হিসেবে, মানুষ হিসেবে বন্ধুদের ভাগ্য থেকে নিজেকে আলাদা করতে চায়নি। বলা যায়, ও প্রাণ দিয়েছে স্বেচ্ছায়, মানবতায়।
তিনি আরও লেখেন, আমাদের কিশোর-তরুণদের কারও কারও মনে যখন জঙ্গিবাদী ঘৃণার আবাদ করছে কোনও অপশক্তি, তখন ভরসা এইসব কোমলহৃদয়, কিন্তু অসম্ভব সাহসী তরুণের। ভালোবাসার শক্তি তাদের কতটা অদম্য করে তুলতে পারে ফারাজ তার প্রমাণ। যে অদম্য বাংলাদেশ মাঝেমধ্যেই পানির তলা থেকে উঠে শুশুকের মতো মুখ দেখায়, ফারাজের মধ্যে আমি সেই বাংলাদেশের মুখই যেন দেখতে পেলাম।
ফারুক ওয়াসিফ লেখেন, জঙ্গিবাদের হাতে, ক্রসফায়ারের গল্পে এইসব শুদ্ধ তরুণের মৃত্যু ঠেকাতেই হবে।যে বাংলাদেশ সহমর্মী, যে বাংলাদেশিরা পাশে থাকার সহযোদ্ধা, যে বাংলাদেশ মানবতার জন্য আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ, ফারাজ সেই বাংলাদেশের প্রতীক। ফারাজ মরে আমাদের আশাকে বাঁচিয়ে রেখে গেল।
এদিকে গতকাল শনিবার একই তথ্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানায় এক বিশ্বস্ত সূত্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রটি গুলশান হামলার স্থানে বসেই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফারাজকে ওরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ফারাজ বাকি বন্ধুদের ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি বলে ওকে মেরে ফেলেছে।
এদিকে, গতকাল শনিবার ভারতীয় তরুণি তারুশির খোঁজে হলি আর্টিজান বেকারির পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই ভারতীয় নাগরিক। নাম না জানিয়ে তারা বলেন, বাংলাদেশে তারা কয়েকবছর ধরেই গার্মেন্ট ব্যবসার কাজে এসে বসবাস করছেন। গতকাল রাত থেকেই তারিশির জন্য দুশ্চিন্তায় রাত কাটিয়েছেন। তারিশি আপনাদের কী হয় জানতে চাইলে বলেন, তাদের বন্ধুর মেয়ে। তাকেই খুঁজতে এসেছেন। তারিশির বাবাও বাংলাদেশে গার্মেন্ট ব্যবসা করেন বলে জানান তারা।
ইমাগো স্পোর্পস ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের কো ফাউন্ডার কাজী সাবির তার ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচারটি করেছেন ফারাজের ছবি দিয়ে। সেখানে লিখেছেন, দ্য ব্রেভেস্ট সোল। স্যাক্রিফাইসড হিজ লাইফ টু সেভ হিজ ফ্রেন্ডস।
তিনি আরও লিখেছেন, আমার ছেলেটা বড় হয়ে যেন ফারাজের মত সাহসী হয়…..জীবন দিয়ে দিস বাবা, তাও জঙ্গি হইস না!!!
আরও পড়ুন: আর্টিজানের মালিক সাদাত মেহেদি যা বললেন
/এআর/