বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

46bd826e220c8987b6ae826e4c56fb3e-Universities_of_Bangladesh_BCCNews24বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি প্রবেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমন কী অভিভাবকেরাও। শিক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়; তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ কম। তারা বলছেন, বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলো যে ধরনের রাজনীতি করে, তাতে ছাত্রদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তবে সরকার যে নির্দেশনা দেবে, সেটার অপেক্ষায় রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরাও এর পক্ষে নন বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ১ জুলাই গুলশান হামলা ও ৭ জুলাই শোলাকিয়াতে জঙ্গি হামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসার পর ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরব রাজনীতির দাবি তোলে।

গত ১৭ জুলাই রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সরকারের এক মতবিনিময় সভায় ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরব রাজনীতির দাবি তোলেন। এ দাবির পরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরব রাজনীতি করার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা তোড়জোড় শুরু করেন। এরপর গত ২৭ জুলাই ধানমণ্ডি এলাকার সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কয়েকটি কলেজে কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। 

এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি অনেক আগে থেকেই চলছে জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাধা থাকায় সংগঠনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি এতদিন।

ছাত্রদল সুত্রে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদলের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল। ওই দিন ‘আহসান উল্লাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটি’-তে কমিটি ঘোষণা হয়। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন বলছে, ঢাকার প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠনটির কার্যক্রম চালু আছে। অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। ২০১৩ সাল থেকে সংগঠনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করে। এছাড়া, ২০১২ সালে নগর কমিটিতে যুক্ত করা হয় ছাত্র ফেডারেশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কার্যক্রম।

ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, ধানমণ্ডি এলাকায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা), ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব),ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তা মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজাউদ্দিন তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক এস এস আশফাক ধানমণ্ডিতে অবস্থিত সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, যেখানে ছাত্রলীগ থাকবে, সেখানে জঙ্গিবাদের স্থান নেই। ছাত্রলীগ নেই বলেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরেই এই কমিটি গঠনের কাজ চলছে। কিছু কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেওয়া হয়েছে।

একে একে সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক এমন কী অভিভাবকেরাও।

এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংবিধানে অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও ছাত্রসংগঠন রাখার অধিকারই নেই। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন কার্যক্রম চালাচ্ছে।

উপাচার্য আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ঢুকলে ছাত্রদল ঢুকতে চাইবে, ছাত্র শিবির যেহেতু নিষিদ্ধ নয় তারাও চাইবে। অন্যদিকে বাম সংগঠনগুলোও জায়গা চাইবে। ফলে এখই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠন সরব রাজনীতি চাইতেই পারে; তবে আমরা এর পক্ষে নই। সরকার যে নির্দেশনা দেবে, সেটার অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সরব উপস্থিতি নেই কেন জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ কম। তার কারণ এখানে পড়াশোনার ব্যাপক চাপ। সময়মতো পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট না দিলে শিক্ষার্থীরাই সমস্যায় পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি যদি রাজনীতি করতে চায়, ছাত্ররা তাহলে জটিল সমস্যায় পড়ে যাবে। কারণ, সবাই জানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে তুলনামূলক খরচ বেশি। ফলে, অনেকেই পেটের ধান্ধায় থাকে। কেউ চাকরি করে। কেউ কেউ টিউশনিসহ অনেক কিছুই করে। মূলত ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদেরই আগ্রহ কম।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রিজওয়ান খান বলেন, আমি শুনেছি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রলীগ কমিটি দিয়েছে। কিন্তু আমাদের আগে থেকেই এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা কমিটি দিলেও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোনও কিছুতে তাদের অ্যালাউ (অনুমোদন) করবো না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেতরে কোনও মিছিল-মিটিং করতে পারবে না। বাইরে যা ইচ্ছা তা করুক।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার আবদুল মতিন বলেন, ছাত্রলীগ অথবা কোনও পলিটিক্যাল সংগঠন তাদের কমিটি দিয়েছে কিনা আমাদের এ ব্যাপারে কিছু জানা নেই। তবে ছাত্ররা যদি এটা করেও থাকে, আমরা সেটা মেনে নেবো না। কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নিয়ম আছে, তাতে বলা আছে, কোনও রাজনৈতিক সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না।

এদিকে, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,ব্যক্তিগতভাবে আমি ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করি না। কারণ, এখন ছাত্র রাজনীতি মানেই মারামারি, কাটাকাটি, চাঁদাবাজি। এখানে ভালো মানুষ হয়ে থাকার সুযোগ কম। ভালো হয়ে থাকতে চাইলেও লিডাররা ভালো থাকতে দেবেন না। পড়াশোনা বাদ দিয়ে মিটিং-মিছিলে যেতে হবে। পড়াশোনার ক্ষতির আশঙ্কাটাই বেশি এখানে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আরেক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের কমিটি আছে; তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কোনও কার্যক্রম করতে পারে না। তারা যা করে সবই বাইরে বাইরে। কিন্তু গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি, ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি চাইছে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার জন্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এমন স্বীকৃতি তারা পেয়েই যায়, তাহলে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ তাদের কোনও কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি হয়েছে এমন তথ্য দিয়ে অ্যাসোশিয়েশনে কেউ রিপোর্ট করে, তাহলে সে ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, এতদিন ধরে একভাবে চলছে কিন্তু এখন কী জন্য কমিটি প্রয়োজন হবে, কী দিলে কী হবে, এসব সরকার অথবা মঞ্জুরি কমিশন চিন্তাভাবনা করে দেখবে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক ছাত্রের বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর সমালোচনা করে বলেন, মোটা অংকের টাকা ঢেলে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। কারণ, তারা যেন পড়াশোনার সুস্থ পরিবেশ পায়। কিন্তু সেখানে রাজনীতি ঢুকে গেলে তো তাদের শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে পড়বে। এক সময় আমরাও ছাত্র রাজনীতি করেছি। কিন্তু তখন সুস্থ রাজনীতি ছিল, এখন যা আছে, তা অসুস্থ!

সোমবার (১ আগস্ট) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনারাই দেখুন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হলো! মারামারি করে ছাত্রের জীবন গেল। আমরা কি চাই সন্তানরা এভাবে অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যাক! আমরা তা চাই না। আমরা তাদের সুস্থ জীবন দিতে চাই।

আরও পড়ুন: শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রত্যাহার 

/আরএআর/এবি/আপ-এআর/