ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন হলেও সুবিধা পাচ্ছে জামায়াত!

ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন হলেও জামায়াতের আদর্শ থেকে বের হতে পারছে না ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। বরং জামায়াতের দলীয় ব্যক্তিদের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের ৬ মাস না যেতেই ব্যাংকটিতে কর্মরত জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেতন ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া জামায়াতের রোকন ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়েছে নতুন পর্ষদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের সবারই বেতন বাড়িয়েছে নতুন পর্ষদ। এর আগে গত বছরে ইসলামী ব্যাংকের ১৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।

ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই ব্যাংকটিতে যারা চাকরি করেন, তাদের অধিকাংশই পরীক্ষিত জামায়াতকর্মী। বাকিরা জামায়াত নেতাদের আত্মীয়।

এদিকে নতুন পর্ষদের হাতে জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেতন বাড়ানোর বিষয়কে পর্ষদ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে চেতনা থেকে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে, পর্ষদে নতুন যোগদানকারী স্বতন্ত্র পরিচালকরা সেই চেতনার বিপক্ষে কাজ করছেন।' তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের যারা চাকরি করেন, তারা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। যে আর্দশ ৭২-এর মূল সংবিধানের পরিপন্থী। জামায়াতের ওই আর্দশের কারণেই তুলনামূলক কম বেতনে তারা ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেন। এই তথ্য ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের নতুন সদস্যরাও জানেন। অথচ সেখানে নিয়োগ পাওয়ার ৬ মাস না যেতেই জামায়াতপন্থীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে।' তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে যে সব স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের দায়িত্ব ছিল ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখা।'

আবুল বারকাত বলেন, ‘এই ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া সামীম আফজাল নিজেই ইসলামী ব্যাংক নিয়ে লিখেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংক জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত।’ তাহলে সেই বিষয়গুলো বাদ দিয়ে জামায়োতিদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে কেন?'

২০১২ সালে এইচএসবিসির সহায়তায় ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়নের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এইচএসবিসি। এই ব্যাংকের পরিচালক সামীম আফজালের একটি লেখায় বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক ‘সন্দেহজনক খাত’ নাম দিয়ে মুনাফার একটি অংশ সরিয়ে নেয় ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে এবং সেই টাকা ‘বিধিমতো সেবামূলক বিভিন্ন কাজের নাম দিয়ে প্রদান করা হয় একমাত্র দলীয় লোক বা প্রতিষ্ঠানকে।’

এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক সামীম আফজাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এখন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।’ তিনি এ বিষয়ে  কথা বলার জন্য এমডি আবদুল মান্নান অথবা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে এখন ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পর্ষদের সদস্যরা পেশাদার হওয়ায় কাজে গতি বাড়ছে।’

এদিকে এই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকসহ শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ধারার এই ব্যাংকগুলো মুনাফা বা আয় করেছিল ২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। মার্চ শেষে এই ব্যাংকগুলোর আয় হয়েছে ৯৫৪ কোটি টাকা। এই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে ৮ ইসলামী ব্যাংকের গড়ে মুনাফার প্রবৃদ্ধি কমেছে ৬০ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংকটিতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে, তারা ব্যাপকভাবে খুশি হয়েছেন। বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, পরিচালনা পর্ষদে আগে যে সব সদস্য ছিল, তাদের চেয়েও বেশি ধন্যবাদ প্রাপ্য হয়েছেন ব্যাংকের পর্ষদে নতুন যারা যোগ দিয়েছেন। কারণ, নতুন পর্ষদ আসার পরই প্রত্যেক কর্মকর্তার ২০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করেছে।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত দেড় থেকে ২ বছর নিজেদের পছন্দের লোকদের কাজ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন জোর করে কাজ নিত। নতুন পর্ষদ আসার পর এখন ব্যাংকে কাজের গতি বেড়েছে। এখন নিজের মতো করে কাজ করা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত বছর ব্যাংকটিতে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এর ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী ব্যাংকে নতুন করে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যাংকটিতে নতুন যে কয় জন পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সবাই জামায়াত আদর্শের বাইরের লোক।

নতুন নিয়োগ পাওয়া পরিচালকরা হলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহা-পরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী ও ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সাবেক এমডি এম আযীযূল হক। এছাড়াও নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকের মধ্যে আছেন মো. আবদুল মাবুদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থোপেডিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাজী শহিদুল আলম এই ব্যাংকে নতুন করে পরিচালক হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের সদস্য বোরহান উদ্দিন আহমেদও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেডের সিইও মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নতুন যোগ হয়েছেন। একইভাবে এই ব্যাংকে পরিচালক হয়েছেন ড. মো. জিল্লুর রহমান । যিনি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এমডি ও জনতা, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া নতুন নিয়োগ পেয়েছেন মেজর জেনারেল (অব:) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন, মো. সাইফুল ইসলাম (এফসিএ, এফসিএমএ), আইডিবির প্রতিনিধি ড. আরেফ সুলেমান এবং এএনএম সাঈদুল হক খান। এদের মধ্যে  মো. আবদুল মাবুদ, মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, বোরহান উদ্দিন আহমেদ ও ড. মো. জিল্লুর রহমান স্বতন্ত্র পরিচালক। এছাড়া প্রফেসর শহীদুল আলম, মেজর জেনারেল (অব:) আবদুল মতিন ও সাইফুল ইসলাম শেয়ারহোল্ডার ডাইরেক্টর। ড. আরেফ সুলেমান ডাইরেক্টর হিসেবে পুনঃনির্বাচিত  এবং এএনএম সাঈদুল হক খান ডাইরেক্টর নির্বাচিত হন।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকে সর্বনিম্ন দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে বেশি কতজন নিয়োগ দেওয়া যাবে, সে ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এই সুযোগ নিয়ে এখানে স্বতন্ত্র কোটায় বেশি পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পর্ষদে সরকার সমর্থক পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।  ইসলামী ব্যাংকে আগে পরিচালকের সংখ্যা ৯ থেকে ১১ জনের মধ্যে সীমিত ছিল। এখন তা বেড়ে ২১ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত পরিচালক ১২ জন, ৮ জন স্বতন্ত্র পরিচালক। এর বাইরে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পর্যবেক্ষক ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।  বর্তমানে ব্যাংকটিতে বিদেশি পরিচালক রয়েছেন ৪ জন।

১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ব্যাংক। মানবতাবিরোধী অপরাধে আব্দুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের রায়-পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীদের রোষানলে পড়ে ব্যাংকটি।

আরও পড়ুন:

‘সব শেষ করেছি, কিছু আর বাকি নাই’

 রামপাল ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করবেন খালেদা জিয়া

/এমএনএইচ/আপ-এনএস/