কল্যাণপুর থেকে পাইকপাড়া: জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নতুন মাত্রা

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের অভিযানে নিহত তামিমসহ তিন জঙ্গি

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নতুন মাত্রা পেয়েছে। গুলশান হামলার ২৬ দিন পর পুলিশ কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়। ওই অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। তবে গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত নব্য জেএমবি’র নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরী সেদিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কল্যাণপুর অভিযানের এক মাসের মাথায় গতকাল (শনিবার) সকালে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ অভিযানে দুই সহযোগীসহ তামিম আহমেদ চৌধুরী নিহত হয়েছে। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তামিম চৌধুরীর চ্যাপ্টার এখানেই শেষ হয়েছে। অন্য জঙ্গি ও মাস্টারমাইন্ডরাও ধরা পড়বে।’

গুলশান, কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযানে অংশ নেওয়া গোয়েন্দা ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ১ জুলাই শুক্রবার রাতে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিক ও তিন বাংলাদেশিকে হত্যা করে। পরদিন শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। অভিযানে নিহত অন্যজন হচ্ছেন হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। তাকে জঙ্গিদের সহযোগী বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

গুলশান হামলার এক সপ্তাহ পর শোলাকিয়ায় হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেখানেও জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন। পুলিশ ও জঙ্গিদের গোলাগুলির মধ্যে নিজবাড়ির ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঝর্ণা রানী ভৌমিক। এ সময় আবির রহমান নামের এক জঙ্গিও নিহত হয়। শোলাকিয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আহত অবস্থায় আটক হওয়া জঙ্গি শফিউল ইসলাম শফি ময়মনসিংহের নান্দাইলে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর গোয়েন্দারা জানতে পারেন এসব ঘটনার পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। এছাড়া নুরুল ইসলাম মারজান নামের আরও এক মাস্টারমাইন্ডের সন্ধান পান গোয়েন্দারা। তামিম চৌধুরী জেএমবি’র নতুন ভার্সন ‘নব্য জেএমবি’র নেতৃত্ব দিতে থাকেন। মারজানও নব্য জেএমবি’র অন্যতম নেতা হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার কমান্ডার হিসেবে কাজ করছেন মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। তামিম চৌধুরী ও মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে গত ২ আগস্ট ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।

কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত নয় জঙ্গি

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি জেএমবি’র এক সদস্যকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার ওই বাড়িটিতে অভিযান চালানো হয়েছে।’

কল্যাণপুরের অভিযানের পর আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, জঙ্গিরা আরও একটি হামলার পরিকল্পনা করছে। ওই গ্রুপটি কল্যাণপুরের কোনও স্থানে অবস্থান করছে। বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ও মেসে তল্লাশির এক পর্যায়ে কল্যাণপুরের আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। এরপরই পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়।  শনিবার নারায়ণগঞ্জের অভিযানের পর আইজিপি বলেন, ‘গুলশান ও শোলাকিয়াসহ দেশে সাম্প্রতিক সব জঙ্গিহামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে নিও জেএমবি’র নেতা জঙ্গি তামিম। পরে তারা গোয়েন্দা তথ্য পান, তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই পাইকপাড়ায় অভিযান চালানো হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো অভিযানের ফলে জঙ্গিদের তৎপরতা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে পড়বে। তারপরও জঙ্গিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান অব্যাহত থাকবে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় যাতায়াত ছিল তামিম চৌধুরীর। কিন্তু ২৬ জুলাইর অভিযানে সেখানে ৯ জঙ্গি নিহত হলেও তামিম চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন জঙ্গি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত অপর দুই জঙ্গির মধ্যে একজন কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় ছিল। অভিযানের শুরুতে একে ২২ রাইফেলসহ সে পালিয়ে যায়।

গুলশানে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গি

নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানা পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হুজুগে চলি না। সবকিছু তদন্তের ভিত্তিতে কাজ করে থাকি। আমরা যেটা বাস্তব সেটা নিয়েই কাজ করি। জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর চ্যাপ্টার এখানেই শেষ হয়েছে। অন্যদেরও দ্রুত ধরতে সক্ষম হব আমরা।’

শনিবার বিকালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জঙ্গিবাদবিরোধী এক আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আইএসের কোনও অস্তিত্ব নেই। এখানে যারা জঙ্গি কার্যক্রম করছে, তারা দেশীয় জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামজা ব্রিগেডের সদস্য। তাদের শেকড় একই জায়গায় প্রোথিত।’ তিনি বলেন, ‘যারা জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে, তারা সংখ্যায় বেশি নয়। অনেকে অপরাধ স্বীকার করে ফিরে আসছে। যারা এ পথ থেকে ফিরবে না তামিম চৌধুরীর মতো পরিণতি তাদেরও ভোগ করতে হবে।’

/এমএনএইচ/আপ-  এপিএইচ/

আরও পড়ুন: