সংশোধনের পরেও বিকৃত ইতিহাস কওমি পাঠ্য বইয়ে

কওমি পাঠ্য বইয়ে

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত ইতিহাস,পাকিস্তান প্রীতি ইত্যাদি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যবই সংশোধন করলেও বিকৃতি রয়ে গেছে কওমি মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে।সমালোচনার মুখে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী লেখকদের নাম বাদ দেওয়া হলেও তাদের লেখা রয়েছে পাঠ্যবইগুলোতে।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, এই তথ্যের বদলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, এমন তথ্য রয়েছে ৫ম শ্রেণির ইতিহাস পাঠ বইতে। সরকার স্বীকৃত পাঠ্যসূচি না থাকায় কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পাঠ করছে ভুল তথ্য, বিকৃত ইতিহাস। ফলে সঠিক ইতিহাস, সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত কওমির শিক্ষার্থীরা। কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যবই ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি কওমি বোর্ডের পাঠ্য বইয়ের ভুল ও বিতর্কিত লেখকদের লেখা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে সংবাদ প্রকাশিত হয়।এরপর বেফাক বিতর্ক এড়াতে কৌশলে পাঠ্যবই সংস্কার করলেও, তাতে তথ্য বিকৃতি দূর হয়নি। ভুলে ভরা এসব বইয়ে নেই আধুনিকতার ছোঁয়া এবং প্রযুক্তি নিয়ে কোনও তথ্য। কোনও কোনও শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থাকলেও তা বিভ্রান্তিতে ভরা। এমনকি নেই স্বাধীনতা দিবসের তথ্যও।

কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৩১টি। মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এসব মাদ্রাসার নেই কোনও সরকারি স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রণ। পাঠ্যসূচিও অনুমোদিত নয়। দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ১৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক বোর্ড। এরমধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হচ্ছে, হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)। প্রায় ৬ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে এই বোর্ডের অধীনে। বেফাকের প্রণীত পাঠ্যবইগুলো পড়ানো হয় অন্যান্য বোর্ডের মাদ্রাসাগুলোতেও।

IMG_20150911_142040

কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যবই ঘেঁটে দেখা গেছে, বেফাক’র পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের ৬১ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধে। যদিও প্রথম প্রকাশের সময় এই প্রবন্ধ ছিল না। ২০১৪ সালে তৃতীয় সংস্করণের সময় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধটি যুক্ত করা হয়েছে। তবে এই প্রবন্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উল্লেখ থাকলেও নেই স্বাধীনতা দিবসের কোনও তথ্য।

এছাড়াও ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এমন তথ্য রয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০১৫ সালে বইটি সংশোধন করে বাদ দেওয়া হয় স্বাধীনতার ঘোষক অংশ। ২০১৬ সালে পুনরায় সংশোধন করা হয় বইটি। সেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে- ‘এমনই এক নাজুক সময়ে ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’ যদিও জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালামের দায়ের করা এক জনস্বার্থ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেন ২০০৯ সালের ২১ জুন।

কওমি মাদ্রাসার বোর্ডের বিভিন্ন শ্রেণির ‘সাহিত্য সওগাত’ (১ম,২য়,৩য় ভাগ) বইতে গদ্য, পদ্য ও প্রবন্ধ থাকলেও কোনও কোথাও লেখক পরিচিতি বা লেখকদের নাম নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখক সম্পর্কে কোনও তথ্য জানতে পারছে না। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে ক্ষুদ্র আকারে বাংলাদেশের জন্ম কথা থাকলেও অন্যান্য শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে তা নেই। চতুর্থ শ্রেণির ‘ইতিহাস পাঠ’ বইয়ে ‘ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমি’ নামে একটি প্রবন্ধ থাকলে, এতে বাংলাদেশ নিয়ে কোনও তথ্য নেই। এই বইটিও সর্বশেষ ২০১৬ সালে সংশোধিত সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

তৃতীয় শ্রেণির ‘ভূগোল ও সমাজ পরিচিতি’ বইয়ের ৩৬-৩৭ পৃষ্ঠায় ‘বাংলাদেশের প্রথম, দীর্ঘতম, বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ’ শিরোনামে লেখায় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে রয়েছে আব্দুল আলীম, শ্রেষ্ঠ কারী মাওলানা ইবরাহীম উজানী, শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পি জয়নুল আবেদীন, শ্রেষ্ঠ খতীব মুফতি আমীমুল ইহসান, শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপি'র নাম রয়েছে। তবে কিসের ভিত্তিতে এই শ্রেষ্ঠত্ব বাছাই করা হয়েছে,তা উল্লেখ নেই।

জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এরমধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামা ইসলামের নেতাদের প্রভাব বেশি। বেফাকের মজলিসে আমেলার মধ্যে কমপক্ষে সাত জন রয়েছেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতা। বেফাকের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মজলিসে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) সদস্য সংখ্যা ৫৫ জন।  রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস সংস্কার, ছাত্র বৃত্তি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব নেতারা রাজনৈতিক দল ও বেফাক উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছেন নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। এরমধ্যে বেফাকে জমিয়তে উলামা ইসলামের প্রভাব বেশি।

IMG_20150911_141645

বেফাকের মজলিসের আমেলার তালিকায় দেখা গেছে, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী মজলিসে আমেলার সভাপতি। জমিয়তে  মহাসচিব  মাওলনা নূর হোসেন কাসেমী বেফাকের সহ সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস বেফাকের সহ সভাপতি,  জমিয়তে  সহ সভাপতি মোস্তফা আজাদ বেফাক সহ সভাপতি, এছাড়া বেফাকের আমেলার সদস্য পদে রয়েছেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মনঞ্জুরুল ইসলাম, জমিয়তে  সহকারি মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, সহকারি মহাসচিব মাওলানা মাসউদুল করিম,জমিয়ত ঘরানার আলেম আবু ফাতাহ মোহাম্মদ ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেফাকের মজলিসে আমেলার একজন সদস্য বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে বেফাকের জন্য বানান নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে বানানের ক্ষেত্রে ভুল সংশোধনের প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে না। এছাড়া তথ্যগত ভুল দূর করার ক্ষেত্রে বেফাকের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অবহেলা রয়েছে। বেফাক কিছু রাজনৈতিক নেতার হাতে জিম্মি। বিভিন্ন দলের পদধারী ব্যক্তিরাই বেফাক নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নে ব্যস্ত। বেফাকের সিলেবাস সংস্কার ও সনদের স্বীকৃতি জরুরি।এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো পথে হাটছেন বেফাকের কর্তারা। বেফাককে বাঁচাতে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবমুক্ত করাও জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশফাক হোসেন বলেন, দেশের সঠিক ইতিহাস জানা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। এক্ষেত্রে পাঠ্য পুস্তকে সঠিক ইতিহাস থাকা জরুরি। রাষ্ট্রের স্বীকৃত ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।

‘স্বাধীনতার ঘোষক’ প্রসঙ্গে পাঠ্য বইয়ের ভুল সম্পর্কে জানতে চাইলে বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেন, ‘এমন কিছু থাকলে বাদ দিতে হবে। নজর এড়িয়ে গেছে হয়তো। সংশোধন করতে হবে।’

পাঠ্য বইয়রে ভুল প্রসঙ্গে আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেন,‘ভুলতো থাকতেই পারে। বইগুলো যাদের দিয়ে করানো হয়, তাদের তথ্য দেওয়া হয়।এখন কী আর করা যাবে। পরের সংস্করণে সংশোধন করতে হবে।’

যদিও ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বাংলা ট্রিবিউনে ‘স্বাধীনতা বিরোধীরা’ই কওমি পাঠ্য-প্রণেতা: রয়েছে ইফাবার দালিলিক সমর্থন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর হলে সেসময় আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেছিলেন,‘বেফাক পাঠ্যবই প্রকাশে অগ্রগতি হয়েছে। ভুল-ত্রুটি থাকায় আগের অনেক বই সংশোধন হয়েছে। এ কাজ প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে। আগামীতে ভুলমুক্ত পাঠ্যবই প্রকাশ করা হবে।’

আরও পড়ুন: ভিসা না পাওয়ায় হজে যেতে পারেননি ৭৫৪ জন

সিএ/ এপিএইচ/