আর আইনমন্ত্রী মনে করেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ আর যেখানেই থাকুক, আমাদের দেশে যেহেতু আইন করে দেওয়া আছে, ফলে সেটি মেনে চলার প্রবণতা তৈরি করা উচিত। এবং এর মনিটরিং থাকা দরকার।
গত শনিবার সকালে রাস্তায় নেমে দেখা যায়, সপ্তাহখানেক আগেই শুরু হয়ে গেছে পতাকা বিক্রি এবং ঝুলানোর প্রক্রিয়া। গাড়িতে ছোট ছোট পতাকাকৃতি কাপড় টানানো। অধিকাংশ ভবনে, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, যানবহন মুড়ে দেওয়া হচ্ছে পতাকা আদলের কাপড়ে। বিজয় সরণীর মোড়ে দেখা গেল, রাস্তায় কিছুদূর পরপর কাঁধে নানা সাইজের পতাকা নিয়ে বিক্রির জন্য হেঁটে চলেছেন বিক্রেতারা। তাদের দাঁড় করিয়ে পতাকাগুলোর মাপ দেখে বুঝা গেল কোনোটির আকৃতিই সঠিক নয়। দৈর্ঘ্য- প্রস্থের মাপেও ভুল। রঙেরও ঠিক নেই।
এগুলোর কোনোটিই পতাকা হয় নাই বলতেই বিক্রেতা রাশেদুন নবী জানান, ‘পতাকা কেন হবে না, সবুজের বুকে লাল সূর্যইতো পতাকা।’ মোহাম্মদপুর টাউন হলের বাইরে একাধিক সেলাই মেশিন নিয়ে দর্জিরা সমানে পতাকা বানিয়ে চলেছেন। এখানে একজন দর্জি বাকী বিল্লাহর কাছে পতাকার মাপ জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘চোখের মাপ। গত দশ বছর ধরে বানিয়ে চলেছি। কিন্তু আসল মাপ বলতে কী বলছেন, তা জানি না। পতাকা পুরো চারকোনা হবে না, একটু লম্বাটে হবে, মাঝে লাল সূর্য।’
জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ বলা আছে, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। এবং লালবৃত্তটি ঠিক কোন অংশে থাকবে, সেটিও উল্লেখ করা আছে। আইনে পতাকার রঙ, ছোট গাড়ি, মাঝারি বা বড় গাড়িতে এর আয়তন সবই লেখার পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের বিষয়েও বলা আছে। ইচ্ছে করলেই যেকেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন না।
এ পরিস্থিতিতে জাতীয় পতাকা কোথায় কখন ওড়ানো যাবে, গায়ে দিয়ে উৎসবে-উদযাপনে পতাকার ব্যবহার করা যাবে কিনা, অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা রোজ ওঠানো নামানোর নিয়ম, নাকি একবারে উড়িয়ে রেখে দেওয়া যায়, সে নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। ইতিহাসবিদরা বলছেন, জাতীয় পতাকার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার সংবিধানে আছে এবং এর নিয়ম কানুন আছে। সে অনুযায়ী এর আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করাটাই নিয়ম। কিন্তু পতাকার রঙ ব্যবহার করে উৎসবে যখন ব্যবহার করা হয়, সেটা পতাকার মতো কিন্তু পতাকা নয়। এবং এ নিয়ে বিতর্ক করার প্রয়োজন নেই।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি মেনে চলার বিষয়ে মানুষকে আগ্রহী করে তোলা জরুরি। পতাকার একটি আইন আছে। এবং সেখানে পতাকা অবমাননার শাস্তির বিধানও আছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই এটি অন্যান্য দেশের মতো যাচ্ছেতাই ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়নি। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং দরকার, যেটি এখনও হয় না বলেই আমার মনে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ভবনে পতাকার ঠিকমতো ব্যবহার হয়। এটি আমি নিশ্চিত। জনগণকে বিষয়টি জানানোর আছে।’ নব্বইয়ের দশকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকালে পতাকা উত্তোলন এবং সূর্যাস্তের আগেই তা নামিয়ে নেওয়ার যে নিয়ম ছিল, এখন তা মানা হয় না কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে সবাই মানবে এমনতো না, কিন্তু বিষয়টি মনিটরিং করা উচিত।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক মনে করেন, পতাকার অবমাননাকর ব্যবহার একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মনে রাখতে হবে পতাকাসদৃশ কাপড় আর পতাকার আকারে ব্যবহার দুটি ভিন্ন বিষয়। যখন পতাকা আকারে ব্যবহারের কথা আমরা ভাববো, তখন যেন মনে রাখি এটিকে একটা জায়গায় ঝুলিয়ে দিলেই হলো না। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এই দেশটি অর্জন, এই লাল সবুজ পতাকা।’
পতাকার মাপ
আইনানুযায়ী ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো- ১০ ফুট বাই ৬ ফুট, ৫ ফুট বাই ৩ ফুট এবং ২.৫ ফুট ১.৫ ফুট।
মোটরগাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো- ১৫ ইঞ্চি বাই ৯ ইঞ্চি এবং ১০ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি।
আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য টেবিল পতাকার মাপ হলো—১০ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি।
ভবনের আয়তন অনুযায়ী এবং প্রয়োজনে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ঠিক রেখে বড় আয়তনের পতাকা প্রদর্শন করা যাবে।
পতাকা উত্তোলনের সময়
ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ), বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) এবং সরকার ঘোষিত অন্য যেকোনও দিন সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিসে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর নির্দেশনা আছে।
ভাষা শহীদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি), জাতীয় শোক দিবস (১৫ আগস্ট) এবং সরকার নির্দেশিত দিনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। তবে অর্ধনমিত করার ক্ষেত্রে আগে পূর্ণ উত্তোলন করে তারপর অর্ধনমিত করার নিয়ম।
যা খেয়াল রাখতে হবে
বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে খেয়াল রাখার জন্য আইনে বলা আছে, কবরস্থানে ‘জাতীয় পতাকা’ নিচু করা যাবে না, বা ভূমি স্পর্শ করানো যাবে না। ‘পতাকা’ কোনও ব্যক্তি বা জড়বস্তুর দিকে নিম্নমুখী করা যাবে না; কখনোই তার নিচের কোনও বস্তু; যেমন- মেঝে, পানি বা পণ্যদ্রব্য স্পর্শ করবে না; কখনোই আনুভূমিকভাবে বা সমতলে বহন করা যাবে না। সর্বদাই ঊর্ধ্বে এবং মুক্তভাবে থাকবে।
আইন অমান্যকারীর শাস্তি
পতাকা আইন অমান্যকারীদের জন্যে এক বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি দেওয়া যাবে।
/ইউআই /এপিএইচ/