প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজে মানবসৃষ্ট ত্রুটির ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। মঙ্গলবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বিমানবন্দর থানায় এ মামলা দায়ের করেন বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) উইং কমান্ডার (অব.) এমএম আসাদুজ্জামান। বিমানবন্দর থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক হিসেবে পুরো বিষয়টির সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল যার, তিনিই মামলার বাদী হওয়ায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
মামলায় বিমানের ৯ কর্মকর্তা-কর্মীকে আসামি করা হয়, যারা বিমানের নিজস্ব তদন্তে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। বিমানবন্দর থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
মামলার আসামিরা হলেন- বিমানের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরী, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স) এস এ সিদ্দিক ও প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (সিস্টেম অ্যান্ড মেইনটেইনেন্স) বিল্লাল হোসেন, প্রকৌশল কর্মকর্তা এস এম রোকনুজ্জামান, সামিউল হক, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, লুৎফুর রহমান, জাকির হোসাইন ও টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমান।
অন্যদিকে এ মামলা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। বুধবার (২১ ডিসেম্বর) মামলা স্থানান্তরের এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম মিয়া।
এর আগে বিমানের তদন্ত কমিটি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে ।বিমান উড্ডয়নের আগে সার্বিক যান্ত্রিক পরীক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্বে ছিল, তারাই ছিলেন বিমানের তদন্ত কমিটিতে। এমনকি মামলার এজাহারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চিফ অব টেকনিক্যাল, চিফ অব ফ্লাইট সেফটি, ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স) কোনও দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা,করলে তা ঠিক মতো করেছেন কিনা, এসব বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, ইঞ্জিনিয়ার অফিসাররা কাজ করেন বিমানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী দেবেশ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। টেকনিশিয়ানরা কাজ করেন বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। গ্রাউন্ডে মেইনটেন্যান্স কন্ট্রোল সেন্টারে (এমসিসি ) তদারকি করেন প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার বিল্লাল হোসেন। কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বিভাগের তদারকি করেন প্রধান প্রকৌশলী এস এ সিদ্দিক। সার্বিক তদারকির দায়িত্বে ছিলেন বিমানের পরিচালক (প্রকৌশল ও ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) উইং কমান্ডার (অব.) আসাদুজ্জামান। এরমধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরীসহ চারজন গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই ফ্লাইটে। যারা আশখাবাদ বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের পর বিমানটি ত্রুটি অনুসন্ধান করে মেরামত করেন।
মামলার এজাহারেও উইং কমান্ডার (অব.) এমএম আসাদুজ্জামান উল্লেখ করেন, তিনি বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট পরিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর বুদাপেস্ট সফরের জন্য বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ই্আর, উড়োজাহাজটিকে নিযুক্ত করা হয়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৬ নভেম্বর উড়োজাহাজটি বিমানের নিজস্ব হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়া হয়। উড়োজাহাজটির ওয়েল প্রেসার সেন্সর মেরামত করা হয়। ওয়েল প্রেসার সেন্সর ও বি-নাট এর অবস্থান কাছাকাছি। আশঙ্কা প্রকাশ করে এজাহারে বলা হয়,মেরামতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে ওয়েল প্রেসার সেন্সরের পাশে অবস্থিত বি-নাট ঢিলা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপরোক্ত কারণ ছাড়াও মেরামতের সময় ধাক্কা দেওয়ার ফলে বি-নাট ঢিলা হতে পারে। উভয় কর্মকাণ্ড নাশকতাও হতে পারে। টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি মেরামতের কাজে জড়িত ছিলেন। প্রকৌশল কর্মকর্তা এস এম রোকনুজ্জামান মেইনটেন্যান্স রিলিজ বুকে স্বাক্ষর করেছেন। প্রকৌশল কর্মকর্তা সামিউল হকের নির্দেশে মেরামতের কাজ করেছেন টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমান। প্রকৌশল কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ও মিলন চন্দ্র বিশ্বাস মেরামতের সময় স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, দায়িত্ব পালন করেননি। প্রকৌশল কর্মকর্তা জাকির হোসাইন সকল ডকুমেন্ট সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, বিমানের প্রধান প্রকৌশলী (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরী ভিভিআইপি ফ্লাইটের চেক ও ইন্সপেকশন টিমের টিম লিডার হিসেবে ওনার কাজ তত্ত্বাবধান করেন নাই। প্রধান প্রকৌশলী (কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স) এস এ সিদ্দিক ভিভিআইপি ফ্লাইটের এসওপি অনুযায়ী তার কাজ তত্ত্বাবধান করেন নাই। প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড সিস্টেম কন্ট্রোল) বিল্লাল হোসেন চার জনের একটি মেইনটেন্যান্স টিম মৌখিকভাবে গঠন করেন বলে জানান। কিন্তু বাস্তবে অনুরূপ মেইনটেন্যান্স টিমের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরখাস্ত হওয়া একজন দায়িত্বশীল প্রকৌশলী বলেন, আমাদের সবার বসতো বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট)। আমাকে মনিটর করার দায়িত্ব চিফ ইঞ্জিনিয়ারের। আবার তাকে মনিটরিং করবেন পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট)। আমি মনে করি, আমাদের রিপোর্টিং বস তার দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) তিনিও আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও তার সম্পৃক্ততা কাগজে কলমে থাকে না, কারণ তিনিতো ওভারঅল ভিউ করেন।এখন পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) কেন, কোন পরিস্থিতিতে মামলা করছেন আমরা জানি না।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আইন শাখা রয়েছে। আইন শাখার দায়িত্ব পালন করেন উপ -ব্যবস্থাপক আজরান আফরিন। এছাড়া, বিমানের পর্ষদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম। বিমানের আইনগত বিষয়গুলো তদারকি করে আইন শাখা।
এ প্রসঙ্গে বিমানের সাবেক একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যিনি সব কিছু তদারকি করার কথা, সব কিছুর দায় যার নেওয়ার কথা, তিনি কিভাবে মামলা করেন। যখন ভিভিআইপি ফ্লাইট হবে তার আগেই সমন্বয় মিটিং হয়। মন্ত্রণালয়ে মিটিং হয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হয়,সিভিল এভিয়েশনে হয়। মিটিং করে এসওপি করা হয়। এসওপি অব ভিভিআইপি ফ্লাইট মানে স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্ল্যান অব ভিভিআইপি ফ্লাইট। মিটিং এ এসওপি ধরে সবাইকে ব্রিফিং করা হয় কে কোন দায়িত্ব পালন করবেন। এসওপি অনুযায়ী নির্ধারণ হয় উড়োজাহাজ কোন সময়ে সার্ভিসিং হবে, চেকিং হবে, কখন উড্ডয়ন হবে সব কিছুই। ইঞ্জিনিয়ারিং টিমকে বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) দায়িত্ব বন্টন করে দেন। তাদের কাজ শেষে তিনি আবার ফিডব্যাক নেবেন এবং তিনি ফাইনালি সেটিসফায়েড হয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) কনফার্ম করবেন। আর বিমানের মামলা করার জন্য তো আইন শাখাও রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে যোগযোগ করা হলে বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্ট) উইং কমান্ডার (অব.) এমএম আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনার কোনও প্রশ্ন থাকলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক অথবা জনসংযোগ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি কোনও মন্তব্য করতে পারব না।’
একই বিষয়ে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এ এম মোসাদ্দেক আহমেদকে পাওয়া যায়নি।
/সিএ/ এপিএইচ/