দেশে বসেই পাওয়া যায় বিদেশি পিএইচডি সনদও!

সনদ প্রদানের নামে নানা ধরনের বিজ্ঞাপনকেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, স্টানফোর্ড কিংবা কলাম্বিয়া— বিশ্বের নামি দামি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার হতাশা অনেকেরই আছে। ভালো ফল থাকার পরেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, আইইএলটিএস, জিআরই ইত্যাদি কোর্সে করেও অনেকের পক্ষে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সম্ভব হয় না। অথচ সবার চোখ কপালে উঠিয়ে দিয়ে নামি দামি এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি বিক্রি করছে রাজধানীরই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান! ঘরে বসেই টাকার বিনিময়ে এসব ডিগ্রি প্রকাশ্যে বেচাকেনা হচ্ছে। অনেকে আবার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার ব্যবস্থা করা ও ভিসা প্রসেসিংয়ের নামেও ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এদের কেউ কেউ দিচ্ছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ পাঠাচ্ছে মোবাইল ফোনে এসএমএস। অনেকে আবার রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সাজিয়ে বসেছে পরিপাটি অফিস, কেউ কেউ ব্যবসা চালাচ্ছে অফিস ছাড়াই। অনেকে আবার তাদের শাখা অফিস খুলে বসেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র তিন লাখ টাকা দিলে মিলে যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, বিদেশি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ডিগ্রি দেওয়ার কোনও অনুমতি নেই কোনও প্রতিষ্ঠানের।
মাত্র ৩ লাখ টাকায় পিএইচডি ডিগ্রির সনদ দেওয়া প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। এসবই প্রতারণার বড় বড় ফাঁদ। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আপনাকে যে ডিগ্রি দেবে তা আপনি কোথাও কাজে লাগাতে পারবেন না।’
ধানমন্ডিতে ভিসা প্রসেসিংয়ের একটি প্রতিষ্ঠানঅনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর সোবহানবাগ, গ্রিনরোড, ধানমণ্ডি, বাড্ডা, গুলশান ১ ও ২ থেকে শুরু করে মোহম্মাদপুরের বেশ কিছু জায়গায় এ ধরনের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। এরা ৩ থেকে ১৭ লাখ টাকায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি এবং ২০ লাখ টাকায় এমবিএ সনদ দেওয়ার অফার দেয়। এমনকি দেশে বসে বিদেশে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি করার প্রস্তাবও তারা দেয়। যারা খোঁজ-খবর না নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে যায় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ২০ থেকে ৩৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। আবার ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে অফেরতযোগ্য ১৪ থেকে ১৮ লাখ টাকাও নিচ্ছে তারা। পাশাপাশি পর্তুগাল, অস্ট্রিয়ার মতো দেশে পড়তে গিয়ে কীভাবে সেখানেই থেকে যাওয়া যাবে সে পরামর্শও দিচ্ছে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান।
জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় পিএইচডিতে ভর্তির বিজ্ঞাপনখোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রিনরোডের ইউরোএশিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশ এমবিএ, ডিবিএ, এলএলএম, এমফিল, পিএইচডি করায় অফার দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বাইরের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি আছে এবং নিজেদের ইউরোপিয়ান অ্যাক্রিডেটেড বলেও দাবি করেছে।
এ বিষয়ে জানতে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে মিনার আহমেদ নামে একজন কথা বলেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনি পিএইচডি করতে চাইলে পুরোটাই দেশে বসেই করতে পারবেন। আমাদের সে ব্যবস্থা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৭ লাখ টাকায় (অন্যান্য খরচ বাদে) পিএইচডি ডিগ্রি করা যাবে। কোন কোর্স নেবেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন এসব বিবেচনায় খরচ এদিক সেদিক হতে পারে।’
কীভাবে ঘরে বসেই ব্যারিস্টার হবেন, জিআরই, টোফেল, আইএলটিএস ছাড়া কীভাবে বিদেশে অ্যাডমিশন নেবেন, কত সহজে ভিসা প্রসেসিং করা যায় এবং কোন দেশে পড়তে গিয়ে থেকেও যাওয়া যায় এসব বিষয় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইনে বিদেশে মাস্টার্সের নামে যা কিছু করানোর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তার কোনও কিছুতেই ইউজিসির অনুমোদন নেই। এ চক্রটি সবচেয়ে বড় প্রতারণা করছে অ্যাডমিশন ও ভিসা প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে।
বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেলফোনেও অফার দেয় নানা প্রতিষ্ঠান। বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) পাঠানো এক খুদে বার্তায় বলা হয়, ‘নিড অরিজিনাল সার্টিফিকেট? বিএ/বিবিএ/ইঞ্জিনিয়ারিং/অনার্স/মাস্টার্স/ এমবিএ/পিএইচডি হানড্রেড পারসেন্ট ভ্যারিফিকেশন, পিওর সার্টিফিকেট উইথ অনলাইন।’ এরপর বার্তার নিচে একটি ফোন নম্বর দেওয়া হয় (০১৭১১১০৮৬৯৯) যোগাযোগের জন্য।
ওই নম্বরে ফোন করলে প্রথমে বাড্ডা লিংক রোডে গিয়ে বিস্তারিত জানতে বলা হয়। পরে টেলিফোনে তাদের প্রতিনিধি বলেন, ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি দেশে বসেই করা যাবে। রাত ৯টার পর ফোন করুন। আপনার যোগ্যতা আছে কিনা জানতে হবে।’ কত টাকা লাগতে পারে জানতে চাইতে তিনি বলেন, ‘পিএইচডির জন্য ৩ লাখ টাকা লাগবে এবং সার্টিফিকেট অরিজিনাল।’
ধানমন্ডির দুইটি ভিসা প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানধানমণ্ডিস্থ প্রিন্সটন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনে গিয়ে দেখা যায় তারা ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের নানাদেশে ভর্তির সুযোগ করে দেয়। এখানে ভিসা প্রসেসিং করতে ১৬ লাখ টাকা নেওয়া হয়। তাদের ভাষায়, ‘আমরা সব করে দেবো। আপনি ভিসার জন্য দাঁড়াবেন। না পেলে আমাদের কিছু করার নেই’। সেক্ষেত্রে কেবল ভিসা ফরম পূরণ ও কাগজপত্র প্রস্তুতির জন্য এত টাকা নেওয়ার অনুমতি কোথা থেকে নিচ্ছেন জানতে চাইলে কেউ কোন কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে ভিসা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এর এবনে হোসেন নামে এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তারা ১২ লাখ টাকা নেবেন ভিসা প্রসেস করতে। আর পর্তুগালে পড়তে গেলে ২ বছরের মধ্যে সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যারিস্টারি ৯ মাস থেকে এক বছরের কোর্স। সেটা দেশে বসে করার কোনও সুযোগ নেই। তবে তিন বছরের আরেকটা কোর্স আছে। সেটা অনেকক্ষেত্রে অনুমোদন থাকলে দেশে বসে করা যায়। শিক্ষার্থী টানার জন্য এ ধরনের অফার দেওয়া হয়। কিন্তু এটা প্রতারণা।’
এসএমএসের মাধ্যমে বিদেশি ডিগ্রির প্রলোভনবাংলাদেশে বসে ৩ লাখ টাকায় বিদেশি পিএইচডি ডিগ্রির সনদ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ হওয়া জরুরি। এখনই এসব বিষয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা দরকার। কারণ তারা ফৌজদারি অপরাধ করছে।’
বাইরের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পড়ার সুযোগ বাংলাদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের আছে কিনা- এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনও সুযোগ নেই। ইউজিসি থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনটিকেই অনুমতি দেওয়া হয় না।’

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

আরও পড়ুন-

‘নারী ও হিন্দুরাও নিয়োগ পাবেন ইসলামী ব্যাংকে’

এমপি লিটন হত্যা মামলায় জামায়াতের আমির আটক



/এসটি/টিএন/আপ-টিআর/