গ্রিল ও তালা দিয়ে আটকানো কেন্দ্ররবিন (ছদ্মনাম) ২০১২ সালে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছবি তোলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল তার। ওই সময় সহপাঠীদের সঙ্গে মজা করতে করতেই হঠাৎই জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা সেবনে। ছয় মাসের মাথায় পূর্ণআসক্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনার পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে রাজধানীর একটি নামকরা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। সেখানে তিন মাসের ‘প্যাকেজ’-এ চিকিৎসা শেষ করেও আরও বাড়তি দুই মাস চিকিৎসা নেন তিনি। এরপর নিরাময় হয়েছে বলে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। যদিও একমাসের মধ্যেই অভিভাবকরা টের পান, রবিন আসলে ইয়াবা সেবনে আবারও জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েক ধাপে তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়েও কোনও ফল পাওয়া যায়নি।
এদিকে, সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেও রবিন পিছিয়ে পড়েন। ২০১৫ সালে বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রবিন নিজেই বুঝতে পারেন, মাদক ছাড়তে হবে। স্ব-উদ্যোগে নিজের মানসিক জোরে তিনি সাত মাসের চেষ্টায় ইয়াবা ছেড়ে দেন। তুলতে থাকেন রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনার ছবি। কাজের মধ্যেই মুক্তি মেলে উল্লেখ করে রবিন বলেন, ‘একসময় বুঝলাম, আমি আসলে মাদক সেবন আর করতে চাই না, কিন্তু শরীরের চাহিদা ও মনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না।’ তাহলে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র কী করলো—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আটকে রেখে, কিছু ভালো কথা বললেই মাদক সেবন থেকে সরানো সম্ভব না। তাদের উপযোগী নানাধরনের কাজে নিয়োগ করতে হবে।’
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে যে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে, সেগুলোয় কাউন্সেলিংটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দক্ষ কাউন্সিলরের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না। বরং তিন মাসের প্যাকেজের হিসাব দেখিয়ে মাদকাসক্তদের অভিভাবকের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন সম্পর্কে অভিভাবকরা জানতে চাইলে, আসক্ত ব্যক্তির মানসিক শক্তি বাড়ানোটাই পুনর্বাসন বলে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপনদেশে মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্ত পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ৬৮টি। তবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেবল ঢাকা শহরেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে সহস্রাধিক। লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার কয়েকটি কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, চড়া দামে নিরাময়ের আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত এমন উদাহরণ পাওয়া দায়।
সিড়িতে ঝাড়ুমোহম্মদপুরের ইকবাল রোডের ক্রিয়া মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, অপরিষ্কার ঘিঞ্জি পরিবেশ। সিঁড়িতে ওঠার মুখে ময়লা ঝাড়ু পড়ে আছে। কথা হয় দায়িত্বে থাকা রেদওয়ান মুস্তাফিজের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন মাসে নিরাময় হয় বলে আমরা বলে থাকি। তবে এরপরও কয়েক মাস লাগতে পারে। প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা খরচ বাবদ ধরা হয়। এখন পর্যন্ত কত শতাংশ মাদকাসক্তকে নিরাময় সম্ভব হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফিফটি পারসেন্টতো হবেই।’
মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র অফিসরাজশাহী শাখার ইনচার্জ নুরুল ইসলাম কেনেডি পুনর্বাসনের ব্যাপারে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক, আচরণ, নৈতিক ও কাজের ক্ষতি জয় আমরা কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে সেটি ফেরানোর চেষ্টা করি। আমরা তাকে কিছু টেকনিক শিখিয়ে থাকি।’ ওই প্রতিষ্ঠানের খুলনা শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাসুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ছোট পরিসরে কাজ করছি। পুনর্বাসন বলতে সামাজিক পুনর্বাসনকেই বোঝাই। সেটা কাউন্সিলররা করেন।’ তিন মাসের প্যাকেজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিন মাসে আমরা তার মৌলিক খরচগুলো করে থাকি। আবাসিকভাবে চিকিৎসা হয় বলেই টাকাটা একটু বেশি লাগে।’
সেবা ফাউন্ডেশনমোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদী হাউজিংয়, রায়ের বাজার, উত্তরা, গ্রিনরোড, এলিফেন্ট রোডের বারাক, মনোচিকিত্সালয়, জীবনের ঠিকানা, আশার আলো সেবা, রি-লাইফ, মুক্তি ক্লিনিকের অবস্থাও একইরকম। উত্তর শাহজাহানপুরে অনির্বাণ মাদকাসক্তি নিরাময় ক্লিনিক নাম দিয়ে একটি নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও সেখানে নেই কোনও সাইনবোর্ড। চারজন ব্যক্তি একটা তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে এটি পরিচালনা করেন। একাধিকবার তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের লোকবল কম হলেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি। মাদকাসক্তদের জন্য কেবল মনোরোগচিকিৎসক বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করলেই হয় না, এটি একজনকে একজগৎ থেকে আরেক জগতে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। এতে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটি খুব সামান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। এমনকি মাদকাসক্তদের কোনও প্যাকেজের আওতায় না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হয়, তাও অনেকে জানেনও না।’
/এমএনএইচ/আপ-এসএনএইচ/
রাজশাহীর ছবি ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি দুলাল আব্দুল্লাহ