রাস্তায় ও বিভিন্ন ভবনে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। যে কোনও সময় গ্রেফতার হওয়ার আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন শ্রমিকদের অনেকে।
মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে শ্রমিকদের অনেকের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেই ভয় থেকেই ঘটনার দিন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ও পরদিন দুপুরে রাস্তার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো তাদের অনেককে ভাঙতে দেখা গেছে।
যদিও শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে লাগানো সিসি ক্যামেরা নয়, আশপাশের ভবনগুলোর ক্যামেরার ফুটেজ, টিভিতে প্রচারিত ফুটেজ সহ পত্রিকা এবং অনলাইনে প্রকাশিত ছবি দেখেও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক জানান, গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে অনেকে কাজ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরিবহন শ্রমিক নেতারাও খুব প্রয়োজন না হলে গাবতলী এলাকায় আসছেন না। মোবাইল ফোনেও কথা বলছেন কম।
এদিকে সংষর্ষে কারা জড়িত ছিল এ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। ঢাকা জেলার শ্রমিকদের দাবি, আন্তঃজেলার শ্রমিকরা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করেছে। আর আন্তঃজেলার শ্রমিকরা দোষ দিচ্ছেন ঢাকা জেলার শ্রমিকদের। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি সমর্থিত শ্রমিক নেতাকর্মীরা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী সদস্য আব্দুর রহিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিক, কাজ করলে টাকা পাই। আন্দোলন করেছে আন্তঃজেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। আর মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে আমাদের।’
এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেই আসামিদের অধিকাংশ ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের জানিয়ে এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের নাম কেন দেওয়া হলো জানি না। আমরা আন্দোলনের নামে ভাঙচুরের পক্ষে নই। আমাদের কোনও নেতা সেদিন রাস্তায় পিকেটিং করেনি। এত মামলার পর শ্রমিকরা কাজ করবে, নাকি গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াবে? এই শ্রমিকরা পালিয়ে থাকলে তো যানচলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।’
একই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা শ্রমিক। কাজ করলে সংসার চলে, না করলে বন্ধ। সংঘর্ষে আমাদের শ্রমিক মারা গেল, আবার আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হলো। তাছাড়া এত মামলার পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।’
নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর জন্য ‘অজ্ঞাতনামা’ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এক পরিবহন শ্রমিক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘হাজারো শ্রমিককে অজ্ঞাত দেখিয়ে মামলা করার পেছনে কারও ফায়দা থাকতে পারে। একই সঙ্গে গাবতলী কেন্দ্রিক ঘটনায় যে কাউকে আটক করে অজ্ঞাতনামা মামলায় ঢুকিয়ে দিতে পারে। এই আতঙ্ক সব শ্রমিকের মধ্যে আছে।’
পরিবহন শ্রমিকদের কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, তারা এখন দুই ভাগে কাজ করছেন। একটি অংশ থাকে টার্মিনাল কেন্দ্রিক টিকেট কাউন্টারে। অন্য অংশটি মহাসড়কে যাত্রী বা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত থাকে। মামলা ও গ্রেফতারের আতঙ্কে রয়েছেন মূলত দ্বিতীয় পক্ষের শ্রমিকরা।
ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে অনেক শ্রমিক কাজে আসছে না উল্লেখ করে জাতীয় সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সড়ক সম্পাদক আব্দুল আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি। কারণ পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা গেলে সবার জন্যই মঙ্গল হবে।’
তবে শ্রমিকদের মামলা বা গ্রেফতার আতঙ্কের বিষয়টি নিয়ে তেমন চিন্তিত নন পরিবহন মালিকরা। যদিও তাদের কাছে শ্রমিকরা নিজেদের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন বলে পরিবহন মালিকদের কয়েকজন এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিবহন মালিক বলেন, ‘পুরো আন্দোলনটা ছিল শ্রমিকদের স্বার্থে। এই আন্দোলনে আমরা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের গাড়ি এই কয়েক দিন চলাচল করেনি। এখন গ্রেফতারের ভয়ে শ্রমিকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সেক্রেটারি মো. সালাউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছি। গাড়ি না চলায় সময়মতো টাকা জমা দিতে পারিনি। শ্রমিকরা আমাদের গাড়িতে কাজ করে। তখন আমাদের কথা ঠিকই শোনে। কিন্তু সিদ্ধান্তের বেলায় তারা ইউনিয়নের কথায় চলে। তাই তাদের ওপর আমাদের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ফারুক তালুকদার সোহেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাথার ওপর এত মামলা থাকলে দুশ্চিন্তা কাজ করে সবার মধ্যে। শ্রমিকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও স্বাভাবিকভাবে চাপের মধ্যে আছে।’
এদিকে দারুসসালাম থানায় একজন শ্রমিক হত্যাসহ পৃথকভাবে পাঁচটি মামলায় ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে ৪০০ থেকে ১২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হলেও এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে সাতজন।
অন্য আসামিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে জানিয়ে দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছি। এগুলো দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।’
প্রসঙ্গত, দুই বাসচালকের বিরুদ্ধে আদালতের সাজার প্রতিবাদে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করেন পরিবহন শ্রমিকরা। গাবতলীতে সেদিন রাতে ও পরদিন তাণ্ডব চালান তারা। এ ঘটনায় নিহত হন এক শ্রমিক। ১ মার্চ দুপুরে শ্রমিক নেতা ও নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের আহ্বানে ধর্মঘট ছেড়ে কাজে ফেরেন পরিবহন শ্রমিকরা।
/আরজে/জেএইচ/এএআর/