কেবল এসপি’র (পুলিশ সুপার) জালিয়াতির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে আমি ও আমার পরিবার ধারাবাহিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমার ছেলে এখনও কারাগারে। এখনও বেঁচে আছে সেই ভরসা। সাদা পোশাকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ধরেই নিয়েছিলাম আর তাকে দেখতে পাবো না—হয় ক্রসফায়ার হবে, না হয় গুম হয়ে যাবে।
কথাগুলো বলছিলেন মানবাধিকার সংগঠন ‘রাইটস’ এর যশোর অফিসের নির্বাহী পরিচালক ও প্রেসক্লাব যশোরের সাবেক সহ-সভাপতি বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক। মঙ্গলবার জামিন পেয়ে ঢাকায় অবস্থানকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এটাই শেষ না, আগামীতে আরও বেশি ভোগান্তি আসছে। আমি থেমে থাকবো না। কাউকে না কাউকে তো প্রতিরোধ করতে হবে।’ তিনি এসপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।
তিনি বলেন, এসপি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আমরা সাংবাদিকরা সহযোগিতা করবো না। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যাওয়ার কথা সেখানে, ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করলে করবে, আমরা করবো না। আজ আমাকে হয়রানি করছে, কাল আরেকজনকে করবে। যশোরের সাংবাদিকরা যদি এক জায়গায় হয় সেটা খুব মারাত্মক রূপ পেতে পারে।
কেন এ পরিস্থিতি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোর শহরের গাড়িখানা রোডের সরকারি জমি (এপি ২০/৭৩) বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা ও দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারীদের অনৈতিকভাবে উচ্ছেদের প্রতিবাদ করায় নিপীড়ন শুরু করেছেন পুলিশ সুপার। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মালামাল বের করে সেখানকার দরজা ইট দিয়ে গেঁথে দেয়। পুলিশের এই অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, এমনকি সেখানকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে হয়রানিও করা হয়েছে বলে দাবি করেন বিনয় কৃষ্ণ মজুমদার। তিনি বলেন, এই জমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে কাঁচাপাকা ঘর ও দোকানঘর নির্মাণ করে ভারত বিভাগের আগ থেকেই স্থানীয় কিছু হিন্দু পরিবার বংশ পরম্পরায় ভোগদখল করে আসছেন। সেই জমির ওপর চোখ পড়েছে, সেটা নিয়ে কথা বলা, গণমাধ্যমে প্রকাশের কারণেই এত বিপত্তি।
ছেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে আইনতই লড়বেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার ছেলে নির্দোষ হয়ে বের হয়ে আসবে। যখন প্রথম জমি জালিয়াতি নিয়ে আমি প্রতিবাদ করি তখনই আমার ছেলেকে একবার ধরে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে বোমা হামলা ও প্রতারণার মামলা দিলো ট্রাফিক সার্জেন্ট ও পুলিশের সোর্স দিয়ে। এর পর গত ৯ মার্চ তাকে তার দোকান থেকে বের হওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে থেকে সিভিল পোশাকে পুলিশ চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি, তাকে গালাগালি করে ক্রসফায়ারে দিতে চেয়েছে। যে ছেলে প্রতিদিন সাড়ে আটটায় বাসায় ফিরে, সে রাত ৯টায় না আসায় খোঁজ নিতে গিয়ে ঘটনাটা জানতে পারি এবং পুলিশকে ডিবিতে জানাই। তারা কেউই কিছু জানে না বলে আমাকে জানায়।
‘পরদিন সকালে ফুলতলা থানা থেকে ফোন করে জানালো, আমার ছেলেকে থানায় আটকে রেখেছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে এবার ফেন্সিডিল বিক্রির মামলা। বিবরণীতে লেখা, সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে ইণ্ডিয়ান ফেন্সিডিল নিয়ে বেচাকেনার উদ্দেশ্যে ঘুরছে। আমি আবারও আইনি প্রক্রিয়াতেই গেলাম। আইনের লোক আইন ভাঙলেও আমি নাগরিক হিসেবে পারি না। এসপি আমাকে হেয় করার জন্য হেন কাজ নেই যা করেননি। ফলে এখন আর পিছু পা হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি আমার সম্মানহানি ঘটিয়েছেন, আমার পরিবারের ওপর চড়াও হয়েছেন।’
নরসিংদীর মামলাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিনয় কৃষ্ণ বলেন, যে ছেলে কেস দিয়েছে ওই ছেলে ইরাক ফেরত। ওই ছেলে ফিরে এসে তার ওপর বিদেশে হওয়া নির্যাতনের কথা বলে ডিবিতে সাক্ষ্য দিয়েছিল। সেসময় যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা গিয়েছিল তারাই উল্টো আমাদের নয়জনের বিরুদ্ধে একটা কেস দিয়েছিল। সেই ঘটনাকে উল্টো দিকে নিতে ইচ্ছেকৃতভাবে নরসিংদীর এসপির সঙ্গে সমন্বয় করে যশোরের এসপি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাকে খুলনা রেঞ্জের লোক ধরে নিয়ে গেছে। আমাকে যারা ধরে নিয়ে গেছেন তারাই বলেছেন, এটা মিথ্যা মামলা।
এ বিষয়ে যশোরের এসপি আনিসুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি সংযোগ কেটে দেন। তারপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
/ইউআই/টিএন/