গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে ৪৬ বছর পরের কালরাত

দীর্ঘ শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা। এ বছর প্রথমবারের মতো দিনটি গণহত্যা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১১ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা বিষয়ক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ। ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২৫ মার্চকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত একটি দিবস হিসেবে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাবের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। 

‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাবে বলা হয়, “সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হউক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হউক।” প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনার পর সংসদে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ সহ ৫৬ জন সংসদ সদস্য এই আলোচনায় অংশ নেন।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ‘ম্যাসাকার’ বইতে লেখা হয়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস।’ এই পরিকল্পনার পথ ধরে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা পরিণত হয় লাশের শহরে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত সহ বিভিন্ন স্থানে তারা নির্বিচারে বাঙালি নিধন করে। ঢাকা সহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করে অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ করে ও মর্টার শেল ছুড়ে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। জগন্নাথ হলে চলে ধ্বংসযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামান সহ ৯জন শিক্ষককে। 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব গত ২০ মার্চ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। দীর্ঘদিন যন্ত্রণা বহন করে চলা শহীদ পরিবারের স্বজনরা মনে করছেন, এই স্বীকৃতি তাদের সামান্য হলেও স্বস্তি দেবে।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহিদ রেজা নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানব ইতিহাসের কলঙ্কতম এক অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিললো। এটা অত্যন্ত পরিতাপের যে বাংলাদেশ নামের দেশ সৃষ্টির মূলে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়, তা জাতীয়ভাবে পালনের কোনও নির্দিষ্ট দিবস পেতে এতদিন সময় লাগলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘোষণার ফলে তিরিশ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত একটি দেশের সব নাগরিক এই দিবস পালনের মাধ্যমে এদেশে সংঘটিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করবে ও বিশ্ববাসীর সামনে মানবতার বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে।’