মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান চিকিৎসকদের

চিকিৎসকদের গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা

সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে তার চাচা হাসপাতালে যেতে নিষেধ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘এখনই আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তা ছাড়া জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।’ কিন্তু তার ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মেজর রিয়াজের নেতৃত্বে একদল পাক হানাদার হাসপাতালে ঢুকে ডা. শামসুদ্দিন আহমদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালা সহ সাত জনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রফিক আহমেদ বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাইরে বোমাবর্ষণ হচ্ছিল, কিন্তু ফেনী হাসপাতালের ভেতরে আমি রোগীদের চিকিৎসা করেছি। ওরা ডাক্তারদের মারে না।’ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপদে থাকলেও পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারেননি ডা. রফিক আহমেদ। বেয়নেট দিয়ে ‍খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে তার তিন ছেলেকে তারই চোখের সামনে জবাই করে হত্যা করে হানাদাররা।

যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য দিনাজপুর সদর হাসপাতালে থেকে গিয়েছিলেন ডা. মো. আব্দুল জব্বার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে বিদায় দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আরে, ডাক্তারের আবার শত্রু আছে নাকি!’ অথচ হাসপাতালের ভেতরে নিজকক্ষে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।

ডা. আব্দুর রহমান সহ নার্স ও রোগীদের হত্যা করা হয়েছিল লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালের ভেতরে।

চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন এর আর্টিকেল চার অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক প্রমুখ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং কখনোই আক্রমণের শিকার হবেন না, হাসপাতাল নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চিকিৎসকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলায় হাসপাতালের প্রবেশমুখেই রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত চিকিৎসক, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম ও ছবি সম্বলিত স্মৃতিফলক। ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা স্মৃতিফলকটিতে রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শহীদ হওয়া ৮১ জন চিকিৎসক ও ১৭ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর নাম।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক অধ্যাপক ডা. খাজা আব্দুল গফুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা জীবনের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ দিয়ে গেছেন। তাদের সম্মান জানাতেই এ প্রচেষ্টা। তবে আরও অনেক শহীদ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর নাম স্মৃতিফলক থেকে বাদ পড়েছে।’

চিকিৎসকদের গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা

‘মু্ক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ’ নামে একটি বই লিখেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) পরিচালক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে তিনি ১০০ জন চিকিৎসক এবং ১৫ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন, তুলে ধরেন তাদের কী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর আল-শামস, রাজাকাররা।

ডা. বায়জীদ ‍বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি কেবল সেই সময়ের রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের কথা বইয়ে উল্লেখ করতে পেরেছেন। পাশাপাশি রয়েছে কয়েকজন হোমিওপ্যাথ, আয়ুর্বেদ এবং পল্লী চিকিৎসকের কথা। কিন্তু সম্পূর্ণ তথ্যের অভাবে তাদের নিয়ে বিস্তারিত লিখতে পারেননি। বইয়ে ১০০ জন চিকিৎসকের স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করা সহজ ছিল না মন্তব্য করে ডা. বায়জীদ  বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৯ সালে কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে থেকে শুধু নাম অথবা একটি সূত্রের খোঁজ ধরে এই মহান বীরদের খুঁজে পাওয়া ছিল মহাকাশে উল্কাপিণ্ড খুঁজে পাওয়ার মতো। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি তালিকা ছিল কাঠে খোদাই করা। কিন্তু তারা কারা, কিভাবে শহীদ হন খোঁজ নিতে গিয়ে কোনও তথ্যই পাচ্ছিলাম না।’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী সেসময় সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য বেশিরভাগ সময় থাকতেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিক্যালের তৎকালীন আবাসিক সার্জন ডা. আজহারুল হক বহির্বিভাগ দিয়ে নানা কৌশলে হাসপাতালে ঢোকাতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। আর হাসপাতালে চিকিৎসারত মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করতেন ডা. ফজলে রাব্বী।’

চিকিৎসকদের গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা

শহীদ অধ্যাপক ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে  বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ চিকিৎসকদের চিকিৎসা দানের কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকার কথাও বলতে চাই। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস নয়, মুক্তিসংগ্রামের ২৩ বছরে তাদের বিশাল অবদান ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেইন গেইটের কাছে। আমার বাবা ডা. আলীম চৌধুরী কেবল বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক নন, একজন ভাষাসৈনিকও। ১৯৫৪ সালে শহীদ দিবসে পতাকা উত্তোলনের কারণে তাকে গ্রেফতার করাও হয়।’

চক্ষু বিশেষজ্ঞ আলীম চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ডা. ফজলে রাব্বীকে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য সহ আলবদরদের দল সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। এ দুজন ছাড়া অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিটি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসবা কেন্দ্রে চিকিৎসকরা নানাভাবে অংশ নিয়েছেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, ওষুধ সরবরাহ করেছেন। কেবল চিকিৎসকরা নন, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানাভাবে অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। চিকিৎসকদের গাড়িতে করে সরবরাহ হয়েছে অস্ত্র, ওষুধ, তাদের গাড়িতে  যাতায়াত করেছেন ‍মুক্তিযোদ্ধারা। জীবন বাঁচিয়ে এবং নিজের জীবন দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন চিকিৎসকরা।

এএআর/

আরও পড়ুন: ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’