১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোন সহ অন্যান্য সরঞ্জাম আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয় বা দলীয়ভাবে এগুলো সংরক্ষণ করা না হলেও নিজেদের সংরক্ষণে রেখেছে মাইক্রোফোন ও মাইক সরবরাহকারী বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘কল-রেডী’। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোন, স্ট্যান্ড ও মাইকগুলো জাতীয়ভাবে সংরক্ষণের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এখন।
তারা জানান, ‘কল-রেডী’ শুরু করেছিলেন দুই সহোদর দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ। ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের একরামপুরে ছোট একটি দোকানে যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। আলোকসজ্জার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া দিতেন তারা। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল আরজু লাইট হাউজ। কয়েক বছর পর নামকরণ করা হয় কল-রেডী।’
দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হলে সভা-সমাবেশের জন্য মাইকের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা পূরণে দেশের বাইরে থেকে বেশ কিছু মাইকের সরঞ্জাম কিনে আনে ‘কল-রেডী’। বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘সেই যে শুরু, এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে কল-রেডী ছিল অন্যতম অংশীদার।’
সেই সময় ঢাকা শহরে এতগুলো মাইক লাগানো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে জানান ত্রিনাথ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘বাবার কাছে শুনেছি, ভাষণের একদিন আগে লাগানো হয়েছিল মাইকগুলো। পাকিস্তানি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে গাছের পাতার আড়ালে লাগানো হয়েছিল। লাগানোর পর সেগুলো ঢেকে রাখা হয়েছিল, যাতে কারও চোখে না পড়ে।’
সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর পাকিস্তান বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় ‘কল-রেডী’। বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদাররা আমাদের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবা-কাকা নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন।’
বঙ্গবন্ধু কখনও ‘কল-রেডী’র কার্যালয়ে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে ত্রিনাথ ঘোষ বলেন, “বাবা ও বড়দের কাছে শুনেছি, যুদ্ধের আগে-পরে অনেকবার এসেছেন। সূত্রাপুর সিভিল ডিফেন্সের অফিসে আসা-যাওয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর। আমার বাবাকে অনেক ভালবাসতেন, তাকে ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন তিনি।’
বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার খবর রাতেই পেয়েছিলেন বাবা। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিনও সারা ঢাকায় মাইক সেট করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর সেগুলো আর খুলে আনা হয়নি।’
দেশ স্বাধীনের পর এতগুলো বছর কেটে গেলেও সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ব্যবহৃত ‘কল-রেডী’র সরঞ্জামগুলো স্মারক হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধাররা হতাশ। একদিন এগুলো যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হবে, সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন তারা।
/আরজে/এএআর/আপ-এমও/