মিথুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘কয়েকদিন আগে বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলাম নভোথিয়েটারে। কিন্তু সেখানে আমি ঢুকতেই পারলাম না। শুধু আমি কেন, কোনও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীই সেখানে ঢুকতে পারেন না।পরে বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। এত সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে সবাই বেড়াতে আসেন,অথচ সেখানে আমরা প্রতিবন্ধীরা ঢুকতে পারবো না,এ কেমন কথা।রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যেন সব মানুষ প্রবেশ করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এগুলো তৈরি করতে হবে ।’
নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ প্রতিটি মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে রাষ্ট্রের। যদিও এসব অধিকারের বেশিরভাগই অধরা রয়ে গেছে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে।তাদের প্রাপ্য অধিকারগুলোও বাস্তবায়ন হয় না।প্রতিটি পদক্ষেপে তারা থাকছেন উপেক্ষিত।
প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দের আয়তন বাড়ছে।কিন্তু প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন এবং অধিকারের জায়গা থেকে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সেখানে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন,কেবলমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা প্রতিবন্ধীবান্ধব নয় বলেই মানুষের প্রাপ্য মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।দেশের লঞ্চ স্টেশন,বাস টার্মিনাল,ট্রেন-স্টেশন,এমকি এসব যানবাহনও প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়নি।গণপরিবহনে তাদের ওঠানামার সুযোগ নেই।শহরের সড়কগুলোতেও প্রতিবন্ধীরা চলাচল করতে পারে না, ফুটপাতগুলোও তাদের জন্য সহায়ক নয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ১ কোটি ৫০ লাখ প্রতিবন্ধীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু বরাদ্দ ১ টাকা ৫৯ পয়সা। প্রতিবন্ধীদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দেওয়ার কথা বলা হলেও বাজেটে তাদের জন্য দেওয়া সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত। তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টিও এখানে উপেক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবন্ধীদের চলাচলের পরিবেশও সৃষ্টি করা হয়নি কোথাও। আর কেবলমাত্র যাতায়াতের এই অসুবিধার জন্য অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ তে বলা হয়েছে- ‘জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সব সুবিধা ও সেবাগুলো অন্যদের মতো প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তির অধিকার বুঝায়।’ আইনে আরও বলা হয়েছে, ‘সর্বসাধারণ গমন করে এরূপ বিদ্যমান সকল গণস্থাপনা,এই আইন কার্যকর হবার পর, যথাশীঘ্র ও যতদূর সম্ভব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরোহণ, চলাচল ও ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।’
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের মোট সংখ্যা কত সেটা নিয়েও নির্ভরযোগ্য কোনও পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা নয় দশমিক সাতভাগ প্রতিবন্ধী রয়েছে। সে হিসাবে ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ। অপরদিকে, সমাজসেবা অধিদফতর বলছে, তিনবছর ধরে করা এক জরিপে সারাদেশে তারা ১৪ লাখ ৮৫ হাজার প্রতিবন্ধী খুঁজে পেয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ’ এর সহকারী প্রকল্প পরিচালক তালুকদার রিফাত পাশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণপরিবহনে আমাদের প্রবেশের সহজ উপায় নেই। নেই দেশের পার্কগুলোতে প্রবেশাধিকার। বিশেষ করে রাজধানীর পার্কগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীরা ঢুকতেই পারবেন না।’
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা ‘এনশিওর আওয়ার রাইটস’ এর একজন মো. মিথুন বলেন,‘পরিবহনগুলোতে বিশেষ আসন সংরক্ষণ করা হয়।কিন্তু আমরা তো বাসে উঠতেই পারি না।’ বাসগুলো কি সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত সময় নিয়ে আমাদের জন্য দাঁড়ায়? এ প্রশ্ন রেখে মিথুন বলেন,‘ এ নিয়ে বাস মালিকদের কোনও উদ্যোগ আমরা দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘পথচারীদের সুবিধার জন্য ঢাকায় ওভারব্রিজ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা প্রতিবন্ধীদেরকে বোধহয় পথচারীদের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত করেননি। কারণ, ওভারব্রিজগুলোতে হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠার কোনও সুযোগই নেই। অন্যদিকে,সড়কে কোথাও কোথাও জেব্রা ক্রসিং রয়েছে ঠিকই,কিন্তু সেগুলো নিয়ম মেনে ব্যবহৃত হয় না। সিগনালে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়াবে সেটাও আমরা জানি না।’ এসব কারণে রাস্তা পারাপরসহ প্রতিবন্ধীদের যাতায়াত ব্যবস্থায় সর্বজনীন ব্যবস্থার দাবি জানান মিতুন।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্স এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম তাহিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ফুটপাত প্রতিবন্ধীদের চলাচলের অনুপযোগী। অথচ প্রতিবন্ধীদের শারীরিক অক্ষমতার কথা না ভেবেই শহরের অবকাঠামো গড়ে উঠছে। স্থাপনা,ভবন এবং ফুটপাতে ঢালু পথ বা র্যাম্প, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল ব্লক, লিফটে ফ্লোর অ্যানাউন্সমেন্ট, ব্রেইল বাটন, শ্রবণ এবং বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু ছবি ব্যবহার করা যায়।এতে করে তাদের চলাচল সহজ ও সহায়ক হয়।
/এপিএইচ/