রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার সাভারের পোশাককর্মী মাহমুদুল হাসান হৃদয়। রানা প্লাজার (৮ম তলায়) নিউ ওয়েভ স্টাইল গার্মেন্টের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন ইয়াসমিন আক্তার ইতিকে। বিয়ের তিন দিন পরই ঘটে দুর্ঘটনা। ধসে পড়া ভবনের নিচে আটকে পড়েন হৃদয়। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর ফায়ারসার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভারের সীমা ক্লিনিক, পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করেন। মাসের পর মাস বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েন হৃদয়-ইতি দম্পতি। ততদিনে হৃদয় সুস্থ না হয়ে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে থাকেন। এদিকে ইতি তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
হৃদয় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও সুস্থ হতে পারিনি। পাঁজরের হাড় ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারওপর একটি পা অবশ হতে থাকে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলতে গেলেও আরেকজনের সাহায্য লাগে। এমন অবস্থা সইতে না পেরেই, আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে গেছেন। গর্ভের সন্তানও নষ্ট করেছেন। নানাভাবে চেষ্টার পরও, ২০১৫ সালের জুন মাসে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
একই যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে আছেন পোশাককর্মী জেসমিন আক্তার (২৮)। তিনি এখন সাভারের সবুজবাগ এলাকার খান সাহেবের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ক্ষতিপূরণের টাকায় একটি মুদি দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছিলেন হাত, পা ও মাথায়। ভেঙে গেছে তার মেরুদণ্ড। মাঝে-মধ্যেই পা থেকে কোমর পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন জেসমিন। ৬ বছরের কন্যাসন্তান ছাড়া তার কাছে আর কেউ নেই। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, এটি বুঝতে পেরেই গত বছর তার স্বামী তাদের ফেলে চলে গেছেন।
প্রসঙ্গ তুলতেই জেসমিন আক্তার প্রচণ্ড ক্ষোভে থরথর করে কাঁপতে থাকেন। ফের শান্ত হয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘এখন আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। সবসময় মেয়েটাকে গাল-মন্দ করি। শব্দ হলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। খালি পায়চারি করি।’ আবেগ-তাড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন চাকরি করতাম, তখন ছিল আমার সুখের সংসার। এখন আমি দরজা বন্ধ করে হু-হু করে কাঁদি। কাউকে বলতে পারি না আমার কষ্টের কথা। মনে হয়, আমি মরে গেলেই শান্তি পেতাম। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে মরতেও পারি না।’
একই পরিণতি ঘটেছে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার শিকার পোশাককর্মী কন্যা রীতা খাতুন, রিক্তা ও লাভলীর জীবনেও। ভবন ধসের সঙ্গে-সঙ্গে বদলে গেছে তাদের জীবনের গল্প। ভেঙে গেছে তাদের সাজানো সংসার।
রিতা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবারও মেরুদণ্ডে ব্যথা হচ্ছে। তলপেটে ইনফেকশন হয়ে গেছে। সাভারের সুপার ক্লিনিকে ১৫ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। আমার স্বামী আতিয়ার রহমানও দীর্ঘদিন হলো ফেলে গেছেন। এখন সংসার বলতে কিছুই নেই।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
/এমএনএইচ/আপ-এআর/