আজ মে দিবস: শ্রমিক সংগঠনগুলোর ‘স্ট্রাগল’ কি শ্রমিক স্বার্থেই?

কর্মরত শ্রমিকরাআজ ১ মে, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের দিন। দিনটি অধিকার আদায়ে শ্রমিকের স্বর শোনার দিন হিসেবে পালিত হয়ে এলেও বর্তমান শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। শ্রমিকরা বলছেন, সংগঠন করে কী হবে? শ্রমিকের কথা কেউ বলে না। তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসে না। তবে, শ্রমিক সংগঠনগুলো এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, তাদের ‘স্ট্রাগল’ পুরোটাই শ্রমিকদের ঘিরেই।


শ্যাওড়াপাড়ার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক আমিনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি শুরুর দিকে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচির ডাক পেতাম। নিজের প্রয়োজনে লাগবে ভেবে যেতামও। কিন্তু এখন নামে মাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আমার নিজের কোনও কর্মকাণ্ড নেই।’ তিনি বলেন, ‘সংগঠনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো, তারা কোনও দিনই আমাদের কথা শুনতে চায় না। নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়। আমি যখন যেটা চাই, সেটা হয় না।’
মিরপুর কালশীতে কর্মরত পোশাক শ্রমিক আলেমুন জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কাজ করি, দিনে আনি দিনে খাই। মাথা নিচু করে কারখানায় ঢুকি, মাথা নিচু করে কাজ করি, এরপর বের হয়ে আসি। আজকের দিনে কী খাব, তার নাই ঠিক, সংগঠন করে কী হবে?’ কিন্তু শ্রমিকের ইউনিয়ন করা, সংগঠন করা অধিকার আদায়ের একটি উপায়, সেটি মানেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিজের বাঁচা নিজে বাঁচতে শেখে মানুষ। কোনও সংগঠনের সঙ্গে শ্রমিক থাকলে সে নিরাপদ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এত সংগঠন আছে, ঠিক ঠাহর করতে পারি না, কোনটা আসল, কোনটা নকল।’শ্রমিক
তার সহকর্মী লাইলী, নাহার, সীমা, রেজাউলের সঙ্গেও কথা হয়। তারা প্রত্যেকে সংগঠনের ডাকে নানা কর্মসূচিতে যান বলে উল্লেখ করেন। সুইং ম্যানেজার রেজাউল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যাই, কারণ আমাদের অভিভাবক নেই। কিন্তু আসলে আমরা জন্মেছিই কেবল নিজেদের শ্রম বিক্রির জন্য। শ্রমিকের অধিকারের কথা শুনেই গেলাম, এ কী জিনিস, তা বুঝলাম না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি শ্রমিকদের নানা কর্মসূচিতে যাই কিন্তু কোনও সংগঠনে নেই। একেক সংগঠন একেকভাবে আমাদের দলে টানতে চেয়েছে গত দশবছরে। তারা যেভাবে বলে, সেভাবে যুক্ত থাকা সম্ভব না।’

মে দিবসের ইতিহাস বলছে, ১৮৮৬ সালের এই দিনে শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকে শিকাগো শহরের তিন লাখের বেশি শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন। শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় শ্রমিকের বিক্ষোভসমুদ্রে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ১০ শ্রমিক প্রাণ হারান। শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য ও তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
কর্মরত শ্রমিকরাপরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১ মে তারিখটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করে।
সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালন শুরু হলেও দেশের শ্রম আন্দোলনে তৈরি হয় নানা বিভাজন।
শ্রমিকদের এসব অভিযোগের বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির নেত্রী তাসলিমা আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা সত্যিকার অর্থে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে চান, শ্রমিকরা তাদের সঙ্গেই থাকতে চান। কিন্তু মামলা, হামলা ও চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সরকার ও মালিকদের অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মালিকদের সঙ্গে মিলেমিশে যারা থাকেন, তাদের দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা চলে। এ কারণেই শ্রমিকদের মধ্যে কখনও কখনও শঙ্কা তৈরি হয়।’
গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শ্রমিকরা নানা সময়ে আন্দোলনে যুক্ত হন, দাবি আদায়ের পর আবারও কাজে ফিরে যান। তাদের সংগঠিত থাকা জরুরি কিন্তু সংগঠন করতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলন কতটা শ্রমিক স্বার্থে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ‘স্ট্রাগল’ শ্রমিকের স্বার্থে, শ্রমিকের জন্যই। এখানে এ ধরনের প্রশ্ন অবান্তর। তিনি আরও বলেন, ‘৫০ লাখ শ্রমিকের জন্য যতটা বড় সংগঠন দরকার গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ততটা বড় সংগঠন নয়, সেটি যেমন সত্য, তেমনি সাধ্যমতো আমরা শ্রমিকদের সঙ্গেই রয়েছি এটিও সত্য।’
শ্রমিক সংগঠনগুলোর মালিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও এনজিওকরণের বিষয়ে সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আকতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্রমিকদের জন্য কিছু অর্জন করতে দেন-দরবার মালিকদের সঙ্গেই করা হয়। সেক্ষেত্রে এক ধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয় কিন্তু সেটা শ্রমিকস্বার্থের বিপরীতে নয়।’

ছবি: নাসিরুল ইসলাম
/ইউআই/এমএনএইচ/আপ-এআর/