বটিতে তরকারি কাটার কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সরকারিভাবে ঘোষিত ৩৮টি ঝুকিপূর্ণ কাজের মধ্যে এটি পড়ে না। আর কলি, রাসেল, আব্দুল্লাহর মতো শিশুদের রাস্তায় চকলেট বা ফুল বিক্রি আর গাড়ি মোছার কাজও এই তালিকায় নেই। যদিও সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ি মুছে দুই টাকা পাওয়ার আশায় নয় বছরের আব্দুল্লাহ ছুটন্ত গাড়ির নিচে পড়ে ইতোমধ্যেই তার হাত ভেঙেছে।
শ্রমিক অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, জোরালো দাবি সত্ত্বেও ঝুকিপূর্ণ কাজের তালিকায় গৃহকর্মকে স্থান দেয়নি সরকার।
শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন গৃহকর্ম, ভাঙারি, তুলা কারখানার কাজকে শিশুদের জন্য ঝুকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। সংগঠনের তাদের অভিমত, ৩৮টি কাজের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শিশুর জন্য যেকোনও শ্রমই ঝুকিপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম দিচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু নানা ঝুকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। ‘জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ-২০১৩’ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনও না কোনও শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই বিভিন্ন ধরনের ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুকিপূর্ণ শ্রম নির্ধারণ করে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের অঙ্গীকার করেছে।
আজ ১২ জুন বিশ্ব শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস। শিশু অধিকার সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শিশু শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘সংঘাত সংঘর্ষ ও দুর্যোগের মাঝে শিশুশ্রম থেকে শিশুদের রক্ষা করুন’।
গতবছর ‘শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক শিশুশ্রম নিরসনের নতুন টার্গেটের কথা বলেছিলেন। ওই সময় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শিশুদের জন্য ঝুকিপূর্ণ ৩৮টি কাজকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা সেমিনারে শিশুদের জন্য বড় বড় কথা বলি। আবার বাসায় গিয়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুকে মারধরও করি। মানসিকতার পরিবর্তন না হলে শিশুদের জন্য কোনও কাজই ঝুকিমুক্ত হবে না।’
এই কথার সূত্র ধরেই বাংলাদেশে ইন্সটিটিউট অব লেবান স্ট্র্যাটেজির সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানসিকতার পরিবর্তন এমনি এমনি ঘটে যাবে এটা ভাবার কারণ নেই। অনুদাননির্ভর প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যা ঘটে, শিশুশ্রম নিরসনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের কথা ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সেই টার্গেট অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আবারও ২০২১ সাল পর্যন্ত টার্গেট নির্ধারণ হয়েছে। কিন্তু এজন্য যা কারণীয় তার দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ কি পরিলক্ষিত হয়?’
মানুষের জন্য ফাউণ্ডেশনের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক, গৃহশিশু শ্রমিকরা শ্রমজীবি শিশু জরিপের বাইরেই রয়ে গেছে। যেকোনও কর্মপরিকল্পনা তৈরির আগে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতির সঙ্গে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতির সমন্বয় জরুরি।’
২০১৩ সালের সাভার উপজেলায় ‘এক্সপ্লয়টেশন ইন চাইল্ড লেবার কেস অব সাভার উপজেলা’ শীর্ষক গবেষণার কথা উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, ‘জরিপে অংশ নেওয়া দুই হাজার পাঁচজন শ্রমজীবি শিশুর মধ্যে ৮৫ শতাংশেরও বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। আর ৪৭ শতাংশই জানায়, মা-বাবা তাদের কাজ করতে বাধ্য করেছেন এবং ৬১ শতাংশ সপ্তাহের সাত দিনই কাজ করে। এ পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হলে যে পরিমাণ কর্মসূচি এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দরকার, সে তুলনায় নেওয়া উদ্যোগ অপ্রতুল। এসডিজি এর ৮ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হলে অচিরেই বাস্তবসম্মত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বাজেট জরুরি।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর সরকার। মন্ত্রী ও সচিব দেশের বাইরে থাকায় এবারে দিবসটি পালনে সরকারি কর্মসূচি ২০ মে উদযাপিত হবে।’
/ইউআই/এসএমএ/