তবুও যেতে হবে

বাড়িতে যেতেই হবে, তাই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ওঠাসিনেমার দৃশ্য নয়। ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে শুক্রবার (২৩ জুন) সকাল সোয়া আটটার ঘটনা। তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঢ’ বগির ছাদে ওঠার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করছে এক তরুণী। বগির লাইটের খাঁচায় তার এক হাত। আরেক হাত দরজার হাতলে। জানালার কার্নিশে এক পা। আরেক পা দরজার মুখে। দেখে হতবাক হয়ে যেতে হলো। ট্রেনে ওঠার জন্য মানুষ এমনও করতে পারে! কিন্তু যিনি উঠছেন তার কাছে এটা শুধু ট্রেনে ওঠা নয়, এ যেন বাড়িতেই পৌঁছে যাওয়া! ঘরমুখো মানুষের সবার মনোভাবই এখন এমন- শত কষ্ট হলে হোক, তবুও বাড়ি যেতে হবে।

ঈদ মানেই যেন মধ্যবিত্তদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময়। এ দুটি উৎসব এলেই সবার মনে বাড়ি যাওয়ার আকুতি তৈরি হয়। আপনবাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে ঈদে একবেলাও যদি কাটানো যায়, তাতেই আনন্দে ভরে থাকে মন। তাই ঈদ কাটাতে বাড়ি যাওয়ার পথে অন্যরকম রোমাঞ্চ কাজ করে মানুষের মধ্যে। তখন কোনও কষ্টই আর যন্ত্রণা মনে হয় না। সব যেন হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া যায় নিমিষে।

তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনে আকাশি-গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরা তরুণীকে ছাদে ওঠায় সফল হতে দেখে উদ্বুদ্ধ হলেন অন্য নারীরাও। তাদের যতটা সম্ভব সহযোগিতা করলেন অন্য যাত্রীরা। বিশাল ঝুঁকি নিলেও ছাদে উঠতে পারায় সবার মুখে ছড়িয়ে পড়লো হাসি। তাদের এভাবে উঠতে দেখার সময় শঙ্কা কাজ করলেও তারা ট্রেনের ছাদে চড়ে বসতেই প্রত্যক্ষদর্শীরাও যেন স্বস্তি পেলেন!কারও কারও মুখে শোনা গেলো, ‘এভাবে কেউ ট্রেনে ওঠে?’ আসলেই, এই নারীরা যেভাবে ট্রেনের ছাদে উঠলেন, তাতে ছোটবড় যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। কিন্তু ঈদ উদযাপনের জন্য বাড়ি যাওয়ার আগে অতসব ভাবলে কি আর চলে!

এজন্য স্টেশনে ট্রেন থামলেই হুড়মুড় করে যেভাবে পারা যায় ওঠার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করছেন সবাই। বগির ভেতরে তিল ধারণের জায়গা না থাকায় ছাদ বেছে নিতে হচ্ছে তাদের। শুক্রবার (২৩ জুন) কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রায় সব ট্রেনেরই অবস্থা ছিল এমন। কোনোটিতেই তিল পরিমাণ জায়গাও যেন ফাঁকা নেই। প্রতিটিরই আসন আর বগির অভ্যন্তরে তো বটেই, ছাদেও ঘরমুখো মানুষের ভিড়। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে না উঠতে কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশন কর্তৃপক্ষ থেকেও মাইকে সতর্কবাণী দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু কে শোনে কার কথা!যেভাবেই হোক বাড়ি তো যেতে হবে। এজন্য বগির ভেতরের চেয়ে বাইরেই মনে হচ্ছে যাত্রীসংখ্যা বেশি।

কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী জানিয়ে রেখেছেন, ঈদের আগে প্রতিদিনই প্রায় ২২ হাজারের মতো যাত্রী চলাচলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। তবে যাত্রীর সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। টিকিট কিনতে পারেননি যারা, ছাদে উঠে বসা ছাড়া তাদের আর উপায়ই বা কী!

ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি ফেরাবাসেও ছাদে বসে আপনজনের কাছে যেতে রওনা দিচ্ছেন অনেকে। রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে এ দৃশ্য চোখে পড়েছে। রোদ মাথায় নিয়ে হলেও বাড়িতে আপনজনের সান্নিধ্য পেলে সব কষ্ট যেন মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। লঞ্চেও একই চিত্র। কেবিন বা আসনের টিকিট যাদের নেই, তারা কোনোরকম দাঁড়িয়েই নাড়ির টানে ছুটছেন। তাদের অনেকে ছাদে বিছানা পেতে বসে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সামনের দিকে ভিড় থাকায় অনেকে পেছন দিক দিয়ে নদীপথে নৌকায় চড়ে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে উঠছেন। ছাদে হোক আর যেভাবে হোক, চড়ে বসতে পারলেই যেন হলো। তখন থেকেই যাত্রীদের চোখে-মুখে ফুটে উঠতে শুরু করে ঘরে ফেরার আনন্দ।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী সোম বা মঙ্গলবার উদযাপন করা হবে ঈদুল ফিতর। এ উপলক্ষে গত ২১ জুন থেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরতে শুরু করেছে লোকজন। বৃহস্পতিবার এ সংখ্যা বেড়েছে। এদিনই মূলত অনেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রাজধানী ছেড়েছেন। বাকিরা শুক্রবার ভোর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘরমুখো যাত্রা শুরু করেছে।

রবিবার (২৫ জুন) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে ঈদের ছুটি। তবে সরকারি অফিসসহ অনেক প্রতিষ্ঠানেই শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি। আর যাদের সাপ্তাহিক ছুটি কেবল শুক্রবার, তাদের অনেকে শনিবারও ছুটি নিয়েছেন। ফলে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৃহস্পতিবারই শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি।

ঈদের দিন সকালে সেমাই খেয়ে নামাজ পড়ার পর আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কোলাকুলি আর দুপুরে পরিবারের সঙ্গে মিলে পোলাও-গোশত খাওয়ার আনন্দ হাতছাড়া করতে চায় কে! বছর পেরিয়ে আবার এমন সুযোগ আসায় স্বস্তি মেলে সবার মধ্যে। তাছাড়া ইটপাথরের শহরের একঘেঁয়েমিও দূর হয় ঈদের ছুটিতেই। ঢাকার অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে ছোটেন বলেই ঈদ যাত্রা হয়ে ওঠে ঝক্কি আর যন্ত্রণার। তাতে কি! তবুও তো বাড়ি যেতে হবেই!

ছবি:নাসিরুল ইসলাম

/জেএইচ/ এপিএইচ/