লংগদুর অগ্নিদুর্গতরা টংঘরে

লংগদুর গৃহহীনরা টংঘরে আশ্রয় নিয়েছেন

‘আমার স্বামী মাছ ধরে। সেই টাকা দিয়ে কোনোরকম খেয়েপরে বেঁচে আছি। এখন তো মাছ ধরাও বন্ধ। কোনও ইনকাম নাই। স্কুল খুলে যাওয়ায় দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পাশে টংঘর করে কোনোরকম থাকছি। ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি এলে আর ঘরে থাকা যায় না। সবকিছু বৃষ্টিতে ভিজে যায়। তখন দিনরাত বসে থাকতে হয় বাচ্চাদের নিয়ে’— বলছিলেন লংগদু উপজেলার মানিকজোড় ছড়া এলাকার বাসিন্দা সান্ত্বনা চাকমা।

বাংলা ট্রিবিউনকে এই সাধারণ পাহাড়ি আরও বলেন, ‘ছোট্ট টংঘরেই এখন সবকিছু করতে হয় আমাদের। বাচ্চাদের তো পড়ালেখা সেই কবে থেকে বন্ধ। স্কুল খুললে কী হবে? ওদের তো বই-খাতা কিছুই নাই। আমরা নিজ বাড়িতে ফিরতে চাই, কিন্তু কিভাবে যাবো? এখন তো ঘর করার টাকাও নাই। সরকার যদি আমাদের ঘর করার টাকা দিতো অথবা ঘর নির্মাণ করে দিতো তাহলে বাড়িতে ফিরতে পারতাম। এভাবে আর কতদিন থাকতে হবে তা জানি না। এভাবে আর এখানে থাকতে চাই না। বাড়িতে ফিরতে চাই আমরা।’

টংঘরে থাকছেন সান্ত্বনা চাকমা

সান্ত্বনা চাকমার মতো সাধারণ পাহাড়িদের এখন সবার অবস্থা একই। অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়েছেন তারা। তাদের মতো অগ্নিদুর্গতরা এতদিন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদান কার্যক্রম আবার চালু হওয়ায় এখন তাদের আশ্রয় নিতে হয়েছে টংঘরে।

গত ১ জুন দীঘিনালার চারমাইল এলাকায় পাওয়া যায় লংগদু উপজেলার সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ। এ ঘটনার পরদিন সকালে প্রতিবাদ মিছিল থেকে স্থানীয় পাহাড়িদের দোকান, বসতঘরসহ চারটি গ্রামের দু’শতাধিক বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।

Rangamati pic (13)

স্থানীয় বাঙালিরা এই ঘটনার জন্য পাহাড়ের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দায়ী করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২ জুন সকালে লংগদুবাসীর ব্যানারে নয়নের লাশ নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল উপজেলা সদরে আসার পথে পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় পাহাড়ি তিনটি গ্রামে ২১৩টি বাড়ি ও আটটি দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

কালাচান চাকমা

মানিকজোড় ছড়া বিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট দোকান নিয়ে ব্যবসা করতেন কালাচান চাকমা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘নয়ন আমাদের ছেলে। ওর মৃত্যুর কথা শুনে আমরাও এই বিষয়ে প্রতিবাদ করার কথা ভেবেছিলাম। এমন সময় আমাদের বাড়িঘর পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল। মানিকজোড় ছড়া গ্রামে মোট ৮০টি ঘর ও সাতটি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেখানে আমারও একটি দোকান ছিল। আমাদের এখানে ২ জুন আগুন লাগে সকাল ১০টার পর। আমরা কখনও ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে। আমার দোকানে বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রায় এক লাখ টাকার ওপরে কাঠ ছিল। বাড়িঘর ও দোকান মিলে আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেলো। ২৮ বছর ধরে তিল তিল করে সঞ্চয় করা সবকিছু শেষ হয়ে গেলো নিমিষে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে স্থায়ী শান্তি কখনও আসবে না।’

টংঘর বানাচ্ছেন প্রতুল চাকমা

মানিকজোড় ছড়া এলাকার বাসিন্দা প্রতুল চাকমা বলেন, ‘নয়ন আমার বন্ধু ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। ২ জুন ঘটনার আগের দিন আমরা আত্মীয়র বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর এসে দেখি বাড়িঘর কিছুই নেই। সব পুড়ে ছাই। খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এখন বর্ষার মৌসুম। রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে আমাদের। সেদিনের ঘটনায় আমাদের ফল ও সেগুন চারা গাছ এমনকি পশুগুলোকেও মেরে ফেলেছে। এই নৃশংসতা বলে বোঝানোর ভাষা নেই। বেসরকারিভাবে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে সেই টাকা দিয়ে একবান টিন কিনে টংঘর করে একসঙ্গে তিন পরিবার আছি আমরা। সরকার ঘর করে দেবে, কিন্তু আবার যে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না সেই নিশ্চয়তা আছে? সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সেজন্য সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’  

Rangamati pic (11)

এদিকে গত ৭ জুন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে তারা নয়ন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয় বলে জানায় পুলিশ। নয়নের মোটরসাইকেলও দীঘিনালার মাইনি নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার দুই ব্যক্তি রমেল চাকমা ও জুনেল চাকমা পুলিশকে জানিয়েছে, মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের জন্যই তারা নয়নকে হত্যা করে। তবে নয়ন হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর  চোখ ফাঁকি দিয়ে মোটরসাইকেলটি কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি হত্যাকারীরা। সেটি বিক্রি করতে না পেরে তা মাইনি নদীতে ফেলে দেয় তারা।

Rangamati pic (8)

লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে দুটি মামলায় ৩০ জনের মতো গ্রেফতার আছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।  পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর একটি টিম সবসময় টহলে আছে।’

/এএম/জেএইচ/