মুন্নী বেগমের কথার সত্যতা পাওয়া গেল জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে আসা আরও রোগীর সঙ্গে কথা বলে। জানা গেল, ক্যান্সারের মতো চিকিৎসায় সরকারি একমাত্র বিশেষায়িত এই হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের মেশিনই নষ্ট। এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট বছরের পর বছর ধরে। সিবিসি-সিইসিসহ বেশিরভাগ পরীক্ষাই হয় না এখানে। কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। বন্ধ থাকে ব্লাড ব্যাংক।
গত ৩০ জুলাই মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, এর সিটিস্ক্যান ও এমআরআই কক্ষ তালাবদ্ধ রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। কক্ষের সামনে রাখা হয়েছে মোটরসাইকেল, কাঠের বাক্সসহ নানা কিছু। রোগীরা এখানে অসহায়, ছোট্ট একটি রক্তের পরীক্ষার জন্যও তাদের যেতে হচ্ছে হাসপাতালের পাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।
মুন্নী বেগম বলেন, তার ৭ বছর বয়সী ছেলে সিয়ামের হাতে ক্যান্সার। সেই ফেব্রুয়ারি থেকেই ছেলেকে নিয়ে এ হাসপাতালে আসছেন তিনি। কিন্তু এখানে না করাতে পেরেছেন সিটিস্ক্যান, না এমআরআই। এই হাসপাতালে এগুলো করাতে না পেরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্টগুলো করিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন,‘খরচটা কতোটা বেড়ে যায় সেটা একবার ভেবে দেখেন আপা। সেই সঙ্গে রয়েছে এইটুকুন ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরা। আর আমার ভোগান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম।’ মুন্নী বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পাশে নোয়াখালী থেকে আসা ৬৭ বছরের নেয়ামত আলী বসে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কেমোথেরাপির জন্য গত এপ্রিল মাস থেকে ঘুরছি, আজও আমার কেমো হয়নি। এখানে ভেতরে লোক না থাকলে, টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ না করতে পারলে আমাদের মতো মানুষ সিরিয়াল পায় না, কেবল ঘুরতেই থাকে।’
সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, ক্যান্সার হাসপাতালে দৈনিক পাঁচশ’র মতো রোগী কেমো ও রেডিওথেরাপি নিতে আসেন। তবে প্রতিদিন এ সুবিধা পান দেড়শ থেকে দুইশ রোগী। সিরিয়াল পেতে শিশুদের জন্য কমপক্ষে ৭ দিন আর বড়দের ১৫ দিন সময় দরকার হয়। চিকিৎসার এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে কিছু মানুষ চলে যান বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে, কিছু মানুষ বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন আর কেউবা থেকে যান এ হাসপাতালের করিডোরে।
চিকিৎসকরা বলেন, দেশে সরকারি পর্যায়ে একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল হওয়াতে সারা দেশ থেকে এখানে ক্যান্সার রোগীরা আসেন, যার মধ্যে শতকরা নব্বই শতাংশই নিম্নবিত্ত। এদের মধ্যে যারা লিউকোমিয়া ও হেমাটোলজির রোগী- তাদের রক্ত পরিসঞ্চালন বাধ্যতামূলক। কিন্তু জানা গেছে, এই হাসপাতালের ব্লাডব্যাংক দুপুর ২টার পর বন্ধ হয়ে যায়। যদিও দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাডব্যাংক খোলা থাকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। ব্লাডব্যাংক বন্ধ থাকায় এসব রোগীকে অপেক্ষা করতে হয় পরদিন পর্যন্ত। এটি ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।
এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন সিটিস্ক্যান মেশিন বসানোর কাজ চলছে। তবে সময় লাগবে। এছাড়া, আরেকটি সিটিস্ক্যান মেশিন কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তবে এর টেন্ডার কবে তা আমাদের এখতিয়ারে নেই।’ রেডিও এবং কেমোথেরাপির জন্য সাত থেকে দশ দিন অপেক্ষা করতে হয় কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ২৭৫ জন মানুষের এসব থেরাপি হয়। বিশ্বের কোথাও সেটি হয় কিনা আগে খোঁজ নেন।তারপর এসব নিয়ে প্রশ্ন করেন।’
/জেএ/এএম/