এ বিষয়ে রাজধানীর জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতী আনসারুল হক ইমরান বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য কোরবানির পশু হতে হবে প্রিয় ও পছন্দনীয় এবং সুস্থ-সবল। চতুষ্পদ পশু অর্থাৎ উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কোরবানি দেওয়ার বিধান আছে। তবে হরিণ, খরগোশ দিয়ে কোরবানি করার বিধান নেই। এছাড়া কোরবানির জন্য পশুর বয়সও নির্ধারিত রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উট ও গরু-মহিষে সাত জনে মিলে সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর, গরু-মহিষ বয়স ২ বছর এবং ছাগল, ভেড়া, দুম্বার বয়স এক বছর হতে হবে।’
মুফতি আনছারুল হক ইমরান বলেন, ‘কোরবানির জন্য শিং যুক্ত হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর এমন পশু নির্বাচন করা উচিত। তবে দু’চোখ বা এক চোখের এক তৃতীয়াংশের বেশি অন্ধ, তিন পায়ে চলে বা চার পায়ে ভর দিতে পারে না এমন পশু, পশুর কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকলে, হাড্ডিসার পশু, শিং ওঠেনি অথবা মূল থেকে শিং ভাঙা পশু, যে পশুর একটিও দাঁত নেই, বন্ধ্যা পশু, চর্মরোগের কারণে গোশত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন পশু, গর্ভবতী পশু বা বাচ্চা প্রসবের সময় অত্যাসন্ন পশু কোরবানি করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাদিসের বিবরণে রয়েছে, কোরবানির পশুকে হাশরের ময়দানে শিং, কান, চোখ, লেজ ইত্যাদিসহ হাজির করা হবে। তবে কেনার পর পশু মারামারি করে শিং ভেঙ্গে গেলে, পা ভেঙ্গে গেলে বা অন্য কোনও উপায়ে আহত হলে সামর্থ থাকলে পুনরায় উত্তম পশু কিনতে পারলে উত্তম। তবে কেনা না গেলে সেই পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া যাবে। তবে পশুর পা একেবারেই ভাঙা থাকলে, শিং ভেঙ্গে মস্তিষ্ক আহত হলে, অবহেলা বা অযত্নে যদি পশুটি দোষযুক্ত হয় বা পশু চুরি হয়ে গেলে আগের চেয়ে ভালো পশু কিনে কোরবানি দেওয়া উত্তম।’
মুফতি আনছারুল হক ইমরান বলেন, ‘যিনি পশু কোরবানি দেবেন তার পশুটির ওপর পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। ধার করে বা পথে পাওয়া পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া যাবে না।’
সুস্থ-সবল পশু চেনার উপায় বর্ণনা করতে গিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল সাইন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোফাজ্জল হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুস্থ পশুর বৈশিষ্ট্য হলো- লেজ দিয়ে মাছি তাড়াবে, কান নাড়াবে, অবসরে জাবর কাটবে, নাকের নিচের কালো অংশ ভেজা থাকবে যাতে মনে হয় ঘাম বা শিশির জমেছে, চোখ বড় ও উজ্জ্বল থাকবে, নাক দিয়ে পানি বা সর্দি পড়বে না, ষাড় গরুকে বিরক্ত করলে সহজে রেগে যাবে ও গোবর স্বাভাবিক থাকবে।’
পশুর বয়স কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোরবানির গরুর বয়স দুই বছর হতে হবে এবং ছাগলের বয়স এক বছর হতে হবে। দাঁত দেখে এ বয়স নির্ণয় করা যায়। পশুরু জন্মের পর যখন দাঁত উঠে তখন তাকে দুধ দাঁত বলা হয়। দুধ দাঁত আকারে খুব ছোট থাকে। গরুর দুই থেকে আড়াই বছর বয়সে প্রথম এক জোড়া দুধ দাঁত (মাঝখানের) পড়ে যায় এবং সে স্থানে বড় আকৃতির এক জোড়া স্থায়ী কর্তন দাঁত উঠে। যার আকার দুধ দাঁতের প্রায় দুই থেকে তিন গুণ। যা দেখলে সহজেই গরুর বয়স বোঝা যায়। এভাবে গরুর বয়স বাড়তে থাকে এবং স্থায়ী দাঁতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আর ছাগলের ১২ মাস থেকে ১৫ মাস বয়সে প্রথম এক জোড়া কর্তন দুধ দাঁত (মাঝখানের) পড়ে যায় এবং সে স্থানে বড় আকৃতির এক জোড়া স্থায়ী কর্তন দাঁত উঠে। যার আকার দুধ দাঁতের প্রায় তিন গুণ বড়। যা দেখে ছাগলের বয়স নির্ণয় করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘খামারিরা অনেক দূর থেকে পশু হাটে নিয়ে আসেন। ট্রাক বা ট্রলারে গরু এমনভাবে বাঁধা হয় যাতে নড়তে বা বসতে না পারে। তাছাড়া হাটেও গরুকে সবসময় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ফলে হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি নেওয়ার পর বেশির ভাগ গরু একবার বসলে আর দাঁড়াতে চায় না বা কোনও কিছু খেতে চায় না। তখন অনেকেই মনে করেন পশুটি অসুস্থ্য। প্রকৃত অর্থে পশুটি তখন বেশ ক্লান্ত থাকে। তাই তাকে বিরক্ত না করে অথবা খাবার খাওয়ানোর জন্য জোর না করে ৮-১০ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে দিতে হবে। এ সময় পশুর সামনে শুধুমাত্র ঘাস ও পানি রাখা যেতে পারে। নিজের প্রয়োজনে পশু সেটা গ্রহণ করবে। তবে পশু কেনার সময় বিক্রেতার কাছ থেকে পশুর পছন্দের খাবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া বাড়িতে পশু রাখার জায়গাটি হতে হবে শুকনা।’
কোরবানির আগে পশুকে খাওয়ানোর পদ্ধতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. মো. মোফাজ্জল হোসাইন বলেন, ‘পশুকে পর্যাপ্ত পরিমান সবুজ ঘাস খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন সকালে গরুকে গোসল করিয়ে ঘাস দেওয়া যেতে পারে। গরুর ওজন সাধারণত মাংসের ওজনের দ্বিগুণ হয়। প্রতি একশ কেজি ওজনের গরুর জন্য ৩ কেজি সবুজ ঘাস এবং এক কেজি খড় সরবরাহ করতে হবে। সাধারণত সকাল ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে মধ্যে গরুকে দানাদার খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হবে। কোনও অবস্থাতেই একসঙ্গে দুই কেজির বেশি দানাদার খাদ্য গরুকে দেওয়া যাবে না। দানাদার খাবার দুই কেজির বেশি হলে ভাগ করে দিনে ২/৩ বারে দিতে হবে। সাধারণত একশ কেজি ওজনের পশুরু জন্য এক কেজি দানাদার খাদ্য দিতে হয়। হালকা গরম পানিতে অথবা ভাতের মাড়ের সঙ্গে দানাদার খাদ্য ও লবণ মিশিয়ে দিতে হবে।’
ছাগলের খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছাগল সাধারণত মাটি থেকে না নিয়ে ওপর থেকে টেনে খেতে পছন্দ করে। কাঁঠাল ও আম গাছের পাতা ছাগলের পছন্দের খাবার। তাই বড় কাঁঠাল ও আম গাছের ডাল (পাতাসহ) ভেঙে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া প্রতিদিন ২০০-২৫০ গ্রাম দানাদার খাবার দিতে হয়। ছাগলের দানাদার খাবার লবণ মিশিয়ে শুকনো অবস্থায়ও দেওয়া যেতে পারে।’
এছাড়া কোরবানির ১২ ঘণ্টা আগে পশুকে শুধুমাত্র পানি ছাড়া অন্য কোনও খাদ্য না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক।
আরও পড়ুন: