যেভাবে কারাগারে দু’টি ঈদ কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে চার হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেন। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমলে স্কুলছাত্র অবস্থাতেই সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে, যা বছরের হিসাবে প্রায় ১৩ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে বেশ কিছু ঈদ কাটাতে হয় জেলের ভেতরেই। এর মধ্যে তাঁর দু’টি ঈদ পালনের তথ্য পাওয়া গেছে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে। এ বইয়ে ১৯৬৭ সালের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালনের কথা উল্লেখ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ছবি: ফোকাস বাংলা)‘কারাগারের রোজনামচা’-এর তথ্যমতে, ১৯৬৭ সালের ২২ মার্চের ঈদুল আজহা জেলে থাকাবস্থায় পালন করেন বঙ্গবন্ধু। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপনকে তিনি মর্মান্তিক ঘটনা বলে বর্ণনা করেন। কারণ হিসেবে তিনি এই দিনে বার বার ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবকে মনে পড়ার কথা উল্লেখ করেন। বন্দি হিসেবে তিনি নামাজে যাওয়ার অনিচ্ছার কথাও লেখায় তুলে আনেন।
বইটিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি তো একলা থাকি। একাকী কী ঈদ উদযাপন করা যায়? কয়েদিদের কী নামাজ হয়?’ এমন প্রশ্ন তুলে ‘ঈদের নামাজে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না’ বলে বইটিতে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। পরে জেলার সাহেব নামাজ বন্ধ করে তাঁকে নিতে আসার কারণে তিনি নামাজে যেতে বাধ্য হন। নামাজে গিয়ে তাঁর অনেক রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। নামাজের পরে শত শত কয়েদি তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন বলেও জানান। পরে সবার সঙ্গে হাত মিলান তিনি।
ওই বছরের জানুয়ারিতে পালিত ঈদুল ফিতরও জেলে কাটান বঙ্গবন্ধু, যা ‘কারাগারের রোজনামচা’তে উঠে এসেছে। বইটিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে কারাবন্দি হিসেবে তাকে ১২ জানুয়ারি ঈদ পালন করতে হলেও পূর্ববাংলার ৯০ ভাগ মানুষ পরদিন ১৩ জানুয়ারি ঈদ পালন করেন।
কারাগারের রোজনামচা বইয়ের প্রচ্ছদঈদের আগে ১১ জানুয়ারিতে পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কারাগারের রোজনামচা’তে উল্লেখ আছে, জেলে থাকায় তাঁর ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কিনবে না, ঈদ পালন করবে না বলেও তাঁকে জানিয়ে দেয়। তবে বঙ্গবন্ধু তাদের ঈদ পালন করতে বলেন। ঈদ পালন না করলে সন্তানদের মন ছোট হয়ে যাবে বলেও তিনি স্ত্রীর (বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধু রেণু নামে ডাকতেন) কাছে জানান। তিনি বাচ্চাদের সব কিছু কিনে দিতেও স্ত্রীকে বলেন। একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয়, ঠিক নেই! তবে কোনও আঘাতই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।’
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, অনেক সিপাহী-কর্মচারী রোজা ভাঙতে রাজি না হলেও কয়েদি হিসেবে সরকারি হুকুমে তাদের নামাজ পড়তে ও ঈদ পালন করতে হয়েছে। সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে জাতির পিতা নামাজে যান বলেও উল্লেখ করেন। নামাজের সময় শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল, মহীউদ্দিন (খোকা), সিরাজ, হারুন, সুলতান, নূরে আলম সিদ্দিকী, রাশেদ খান মেনন, নূরুল ইসলাম, চিত্ত রঞ্জন সুতারসহ অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা হওয়ার তথ্যও জানান।
ঈদ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়েরিতে লিখেন, ‘পূর্ব বাংলার লোক সেদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে এবং সত্যিকারের নাগরিক হতে পারবে।’
বইটিতে তিনি উল্লেখ করেন, ঈদের নামাজ আদায় করলেও ওইদিন বাড়ি থেকে ঈদ উপলক্ষে কোনও খাবার-দাবার তিনি পাননি। তবে কারা কর্তৃপক্ষ ওইদিন খাবারের বন্দোবস্ত করে। তাদের মতো যারা বন্দি নন, তারা পরদিন ঈদ পালন করেন বলেও বঙ্গবন্ধু লিখেন। ঈদ উপলক্ষে ১৩ জানুয়ারি অন্যান্য বন্দিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘরে বিছানা পেতে একসঙ্গে খাবার খান বলে জানান। ঈদের পরের দিন ১৪ জানুয়ারি বাড়ি থেকে স্ত্রী রেণু দেখা করতে যান বলে বঙ্গবন্ধু তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেন।