বৈঠকিতে বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ শাহরিয়ার জামান বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সহিংসতা পরিস্থিতিতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের দুর্দশা বর্ণনা করার ভাষা নেই। নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালং অঞ্চলে রাস্তার ওপর দিন কাটাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।’
শেখ শাহরিয়ার জামান বলেন, ‘২৪ আগস্ট ছিল কফি আনানের সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’র বৈঠক। আমরা তো সবাই আশা করছিলাম, পরদিন ওই বৈঠকের খবরই ফলাও করে প্রচার হবে সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে। কিন্তু ওই দিনই রাখাইনে সহিংসতায় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। সেই খবরই জায়গা করে নিয়েছে গণমাধ্যমে। এই কমিশনের প্রতিবেদনও তাই তখন আলোচনায় আসতে পারেনি।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই নিবন্ধনের সত্যতা মিয়ানমার মানতে চায় না। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ভালোমতো বার্মিজ ভাষা শেখানো হলে তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার সময় কাজে দেবে।’
বৈঠকিতে তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘ষাট বা সত্তরের দশকে মতাদর্শের বিভাজনটি স্পষ্ট ছিল। এখন সেই বিভাজনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, মতাদর্শতগত বিভাজনের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ বড় ভূমিকা রাখছে। ফলে চীন ও ভারত এই অর্থনৈতিক স্বার্থকেই বড় করে দেখছে কিনা, তা নিয়ে ভাবতে হবে।’ রাখাইন রাজ্যের রাজনৈতিক বিবেচনাকে ভিত্তি করে সমগ্র মিয়ানমারকে বিবেচনা করা হলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মুন্সী ফয়েজ বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতিটি ধাপে ধাপে আমাদের বুঝতে হবে। মিয়ানমার তো রোহিঙ্গাদের স্বীকার করেই না, তারা রোহিঙ্গা শব্দটিকেই তুলে দিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ তো এই সংকটের কারণে সরাসরি আক্রান্ত। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংকট রয়েছে। কিন্তু এখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানবিক সংকটই আমাদের বেশি ভাবাচ্ছে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ‘মিয়ানমারে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। যারা বাংলাদেশে চলে এসেছে, তাদের পাশে থাকতে হবে। তাদের ফিরিয়ে দেওয়াটা সমাধান নয়; সমাধান তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, তাদেরকে তাদের দেশ- ধর্ম ফিরিয়ে দেওয়া, নিজেদের ভিটেমাটিতে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া।’ বিশ্বব্যপী চাপ সৃষ্টি করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বিশ্ব মূলত বিভাজিত। এরপরও রোহিঙ্গা সংকটে রোহিঙ্গার পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তার পাশে যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া দাঁড়িয়েছে। তবে আমাদের মতো আমাদের আঞ্চলিক দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীন মানবিকতার দিক থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে আশা করেছিলাম। কিন্তু তারা তাদের পাশে নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি মানবিক আচরণ করেছে।’
মেজর জেনারেল (অব.) রশীদ আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি মানবিকতা দেখিয়েছে। প্রধামন্ত্রী নিজে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ত্রাণ, চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা তাদের দেওয়া হচ্ছে। তবে একটি স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এসেছেন। অন্য দেশ থেকেও ত্রাণ আসছে। ভারত আজ প্রথম ত্রাণ পাঠিয়েছে। আমরা আশাবাদী, ভারত ও চীন এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে।’
অস্থায়ী নয়, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তাদেরকে ফেরত পাঠানোই সমাধান নয়। এর আগেও তো তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারা তো আবারও এসেছে। ফলে এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হতে হবে। আনান কমিশনের প্রতিবেদনে এ জন্য অনেক সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এই সংকটের একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব।’ রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ক্যাম্পেই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হারুন উর রশীদ আরও বলেন, ‘চলমান এই রোহিঙ্গা সংকটে এরই মধ্যে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে। এর জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এই নিবন্ধন প্রক্রিয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে যদি তাদের একটি স্থানে নিয়ে না আসা যায়। কিন্তু রোহিঙ্গারা এখন অনেকটা ট্রমাটাইজড হয়ে রয়েছে। তারা অত্যাচারের ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে। তাই তাদের এক জায়গায় আনাটাও খুব কঠিন হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা নিশ্চিত করতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এর পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও রয়েছে। তারা যদি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে যেন সেখানে গিয়ে আবার জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও কূটনীতির মধ্যে না পড়ে যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।’
ব্র্যাক-এর মাইগ্রেশন প্রকল্পের প্রধান শরীফুল হাসান বৈঠকিতে বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের মতো রোহিঙ্গারাও নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এর জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকিও নিতে হচ্ছে। কিন্তু কেন তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ছাড়তে হচ্ছে দেশ? কারণ,তারা জানেন,দেশে থাকলে তাদের জন্য মৃত্যু নিশ্চিত। দেশ ছাড়লে হয়তো জীবনের ঝুঁকি আছে, কিন্তু বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনাও তো আছে। সেই সম্ভাবনা নিয়েই দেশান্তরী হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।’
শরীফুল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বক্তব্য এমন— তারা যদি মিয়ানমারে থাকে তাহলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। সে কারণেই বাঁচার একটু আশা নিয়ে তারা দেশান্তরী হওয়ার ঝুঁকি নেয়। তাদের ওপর সহিংসতা ও তাদের সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে আসার ফলে তৈরি হওয়া মানবিক সংকটই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট। এটা বাংলাদেশের জন্যও বিশাল একটি সংকট। এই ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে কোথায় রাখা হবে,কী খাওয়ানে হবে-সেটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।’
ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাদের ফেরত দেওয়া হবে কিভাবে? মিয়ানমার কি তাদের নেবে? বাড়িঘর ছেড়ে পলিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাকে নিজেদের ভিটেমাটিতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা সারাবিশ্বেরই দায়িত্ব।’
বক্তারা বলেন, চলমান এই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আসতে পারে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ওই প্রতিবেদনে মিয়ানমার সরকারের জন্য মোট ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র দুইটি সুপারিশ বাস্তবায়িত হলেই এই সংকটটি সমাধানের পথে অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে মত দেন ব্ক্তারা। ওই দুই সুপারিশে রাখাইনে মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের নিয়মিত আয়োজন এই বৈঠকিটি এটিএন নিউজ ও বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
আরও পড়ুন-
‘ভোটের রাজনীতির কারণে নিশ্চুপ সু চি’
‘রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বর্ণনা করার ভাষা নেই’
‘রোহিঙ্গাদের স্বীকার করতে চায় না মিয়ানমার’
‘রোহিঙ্গাদের এক জায়গাতে নেওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ’
‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২ প্রতিবেশীকে আমরা পাশে পাইনি’
‘রাখাইনে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই দেশান্তরী হচ্ছে রোহিঙ্গারা’
‘রোহিঙ্গা সংকট বনাম মানবতা’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি শুরু