রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে পাঁচ সংকট

রোহিঙ্গা (ছবি: ফোকাস বাংলা)২৫ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নৃশংস নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা চার লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের স্রোত এখনই থামবে না। এ সংখ্যা আরও কয়েক লাখ ছাড়াবে। এ পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন সংকটের মুখোমুখি রোহিঙ্গারা, অন্যদিকে সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও। গত ২৬ দিনে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার সুরাহা হলেও বেশকিছু সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের ধীরগতির পাশাপাশি টানা বর্ষণে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠাই বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। রয়েছে অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মীরা বলছেন, ছোট্ট একটি জায়গায় হঠাৎ করে আশ্রয় নেওয়া এতগুলো মানুষকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে বিপর্যয় নেমে আসবে। তবে প্রশাসন বলছে, তারা ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গুছিয়ে আনছে।রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ (ছবি: সংগৃহীত)

এ পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা

গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ৮শ মেট্রিক টন খাদ্য ও ৩২ লাখ টাকা সমমূল্যের সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সরাসরি এক লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীর খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। ৭০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী মায়ের বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই হাজার একর জমিতে শরণার্থীদের অস্থায়ী আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে, পয়ঃনিস্কাশনের জন্য নির্মিত হয়েছে ১৬ হাজার শৌচাগার। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য চারটি বড় আকারের পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। শিশুদের জন্য টিকা ও ভিটামিন সরবরাহ করা হচ্ছে, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে জোগান দেওয়া হচ্ছে প্রতিষেধক; পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীও সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি নিরাপত্তা চৌকি, ৪২টি নিরাপত্তা দল ভ্রাম্যমাণ টহল পরিচালনা করছে।রোহিঙ্গা নিবন্ধন (ছবি: আমানুর রহমান রনি)

নিবন্ধনের ধীরগতি

গত ১১ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় ও পরিচয় নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন শুরু করে সরকার। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সহায়তায় এই কাজে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি শরণার্থী তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কুতুপালংয়ে একটি কেন্দ্রে ছয়টি ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় একটি কেন্দ্রে চারটি বুথ খোলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনাকর্মী গওহার নঈম ওয়ারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবার আগে নিবন্ধন জরুরি। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগিয়ে কাজটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে হবে।’বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা (ছবি: আমানুর রহমান রনি)

বৃষ্টি মোকাবিলা চ্যালেঞ্জ

টানা চার দিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বসতিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে ঘর তৈরি ও টানা বৃষ্টির ফলে ধসের আশঙ্কাও করছেন অনেকে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, পাহাড় ধসের মতো ঘটনা ঘটলে তা সামলানোর প্রস্তুতি নেই। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক আমানুর রহমান রনি টেকনাফ থেকে জানান, টানা বর্ষণে মানুষগুলো দুর্দশাগ্রস্ত। যত্রতত্র পাহাড়ি এলাকা পরিষ্কার করে থাকার জায়গা করে নেওয়ায় যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

মানবাধিকারকর্মী আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই বর্ষায় থাকার জায়গা কাদা আর পানিতে ভরা। এ পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই তাদের কোনও এক জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার সময় এখন না। বৃষ্টি থামলে সেই উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

সরকারিভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম

কোথায় খাওয়াচ্ছে, কাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে

মোট আটটি লঙ্গরখানা ও ত্রাণ বিতরণের ১২টি স্থান নির্ধারণ করে এক লাখ মানুষকে প্রতিদিন খাওয়ানোর ব্যবস্থার কথা বলা হলেও ১৯ সেপ্টেম্বর সেই প্রক্রিয়া শুরু করা গেছে। এ ব্যবস্থায় প্রথমদিন ৪০ হাজার মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একলাখ মানুষের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমদিন আমরা ৪০ হাজার মানুষকে খাওয়াতে পেরেছি। ধীরে ধীরে সবজায়গায় এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।’

এদিকে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গুরু কা লঙ্গরখানা খোলার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে শিখদের খালসা এইড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা প্রতিদিন ৩৫ হাজার শরণার্থীর খাবারের ব্যবস্থা করছে।রোহিঙ্গা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সংকট

অপুষ্টিতে ভোগা শিশু আর গর্ভবতী নারী

২৫ আগস্ট থেকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এবং উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে মোট ভর্তি হওয়া রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম। তাদের মধ্যে ডায়রিয়ায় এক হাজার ৫৪১ জন, শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণে তিন হাজার ২৯৩ জন ও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৯২৫ জন। এর বাইরেও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৭ হাজার ৬৮৫ জন রোহিঙ্গা। ইপিআই টিকা দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৪ জনকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে গর্ভবর্তী মা রয়েছেন ২২ হাজার। তাদের মধ্যে ১৭৮ জন গর্ভকালীন জটিলতায় আক্রান্ত। ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুতুপালং কমিউনিটি ক্লিনিকে ১১ জন নারী সন্তান প্রসব করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দাবি, এখন পর্যন্ত অপুষ্টির কারণে কোনও মা ও শিশু মারা যায়নি। একটি শিশু মারা গেছে শ্বসনতন্ত্রের জটিলতার কারণে।

উখিয়ার বালুখালী এলাকায় রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসতি। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন২৬ দিন পর মিডিয়া ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিদিনের নেওয়া ব্যবস্থা ও সহায়তা সংক্রান্ত তথ্য জানাতে বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) থেকে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক। এজন্য ডিসি কমপ্লেক্সে একটি মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে বলে সরকারি তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তাদের খাদ্য-চিকিৎসা-বাসস্থানের প্রাথমিক বিষয়গুলো পূরণের সব উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি। বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে-ছিটিয় আছে। টানা বৃষ্টিতে নিবন্ধনের কাজও তুলনামূলক স্লথগতিতে এগুচ্ছে মনে হলেও সেটা চলমান প্রক্রিয়া।’

রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ বিষয়ে মাহিদুর রহমান বলেন, ‘শুরুতে ব্যক্তি ও সাংগঠনের উদ্যোগে আসা ত্রাণ বিতরণে কিছু বিশৃঙ্খলা ছিল। তবে সেই কাজটিও জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ত্রাণ আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠাচ্ছি। আজ থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিংয়ের আয়োজনও করছি। ধীরে ধীরে সব ধরনের কাজই গুছিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।’

আরও পড়ুন- ‘রোহিঙ্গা এসেছে চার লাখ ২৪ হাজার, নিবন্ধিত হয়েছে ৫৫৭৫ জন’