গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে টেকনাফ যাওয়ার পথে বালুখালী ক্যাম্পের বিপরীতে সড়কে বামপাশে একটি সবুজ পাহাড় দেখা যায়। দুপুর ২টার দেখা যায় গাছপালা কেটে ওই পাহাড়ে থাকার জন্য ঝুপড়ি বানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। শুধু এই পাহাড় নয়, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার অসংখ্য পাহাড়ে এভাবে গাছপালা কেটে এখন বসতি স্থাপন করছে রোহিঙ্গারা। অপরিকল্পিতভাবে তাদের এই বসতি স্থাপনের কারণে একদিকে কমে যাচ্ছে সবুজ, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়ছে হাতিসহ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রের ওপর অত্যাবশ্যকীয়ভাবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
ওই এলাকায় রাস্তার দু’পাশে তাকালেই চোখে পড়বে নীল-কালো প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ঝুপড়ি ঘর। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে বানানো হয়েছে এসব ঝুপড়ি। পাহাড় ছাড়িয়ে আশপাশের সমতল ভূমিতেও ছড়িয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের বস্তি। রাবার বাগান, সরকারি খাসজমি, পতিত ও ফসলি জমি সবখানে এখন শুধু প্লাস্টিকের তৈরি ঝুপড়ি।
চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিরিক্ত শরণার্থীকে আশ্রয় দিলে যেকোনও দেশকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে। পরিবেশ মানে শুধু গাছপালা না, আমরা সবাই। সুতরাং আমরা সবাই হুমকির মুখে পড়ে গেছি। আমাদের প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। জনজীবন হুমকির মুখে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে এমন একটি সংকট আমাদের সামনে এসে পড়েছে। আমরা চাইলে তাকে এড়িয়েও যেতে পারি না। মানুষকে মানুষ বাঁচালে সেটার এক স্বীকৃতি আছে। আমরা সারাবিশ্ব থেকে ওই স্বীকৃতি পাচ্ছি। কিন্তু একই সময়ে আমরা ক্ষতির সম্মুখীনও হচ্ছি। তাই আমাদের ওই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব রাখা উচিত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে আমরা কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি তার হিসেব রাখতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ওই এলাকায় যতদিন থাকবে ততদিন বনাঞ্চল উজাড় হবে। তারা ওই এলাকায় বসতি স্থাপনের পর জ্বালানির জন্য পাহাড়ের গাছপালা কাটবে।’ মো. আলী কবির আরও বলেন, ‘পাহাড়র কেটে ঘরবাড়ি তৈরির ফলে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। বান্দরবান, রাঙামাটির মতো ঘটনা ঘটতেই পারে। আমরা প্রশাসনকে পরমার্শ দিয়েছি তারা যেন পাহাড় বাদ দিয়ে দুই হাজার একর জায়গা নির্ধারণ করেন এবং তাদের জন্য যেন জ্বালানিরও ব্যবস্থা করা হয়।’
হাতির চলাচল পথ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কক্সাবাজার এলাকার সব বনভূমিই হাতির অভয়ারণ্য। নির্ধারিত কিছু রুট থাকে তা দিয়েই হাতি চলাচল করে। ওই রুটের বাইরে কখনও চলাচল করে না। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় হাতির আবাসস্থলে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে একবার হাতির আক্রমণে ওই এলাকায় দুই রোহিঙ্গা মারা গেছে।’
বন সংরক্ষক (চট্টগ্রাম অঞ্চল) ড. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও সময় হাতি ওই এলাকায় আক্রমণ করতে পারে। ইতোমধ্যে একবার হাতি আক্রমণ করেছে। এটা রোহিঙ্গাদের জন্য যেমন, হাতির আবাসস্থলের জন্যও হুমকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে– এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আমরা যদি রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসতে পারি তখন এই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। অন্যথায় ওই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে পারে।’