প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের চিঠি জাল করছে কারা?

সিরাজগঞ্জের ১৯টি বিদ্যালয় সরকারিকরণের ভুয়া চিঠির অনুলিপি

বাদ পড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করে দেওয়ার নামে একটি প্রতারক চক্র দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ জাল করে শিক্ষকদের সঙ্গে এই প্রতারণা করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে প্রতারক চক্রটি। কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করা চিঠি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর তালিকা থাকলেও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন,কারা এ কাজ করছে তা তাদের জানা নেই।

মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে,সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কাজে জড়িত। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে এগোতে চায় না মন্ত্রণালয়। বরং শুধু ‘ভুয়া চিঠির’ ওপর ভিত্তি করে কোনও কার্যক্রম গ্রহণ না করতে জেলা শিক্ষা অফিসারদের গত ১৯ সেপ্টেম্বর নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা বিষয়টি সম্পর্কে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গরিব শিক্ষকরা যাতে প্রতারিত না হন, সে জন্য জেলা শিক্ষা অফিসগুলোকে সচেতন করা হয়েছে। চাহিদা না পাঠানো পর্যন্ত জাতীয়করণ সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়েছে।’

মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা কারা করছে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য রয়েছে।যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রাথমিক শিক্ষক ও বিদ্যালয় কমিটির লোকজনকে আশ্বাস দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কিন্তু তাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন না শিক্ষক কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি।’

ভুয়া স্মারক নম্বর ও উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে দেওয়া একটি চিঠির অনুলিপিমন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গত এক বছরে সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নীলফামারী, বরগুনা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যালয়ের নামে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করা চিঠি ইস্যু করে প্রতারণা করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানার ১৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে এমন জাল চিঠি ইস্যু করেছে দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় থাকা স্থানীয় প্রতারক চক্র। তবে এর সঙ্গে প্রাথমিক ও গণমিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিদ্যালয়-১) পুলক রঞ্জন সাহা এবং উপসচিব গোপাল চন্দ্র দাসের স্বাক্ষর জাল করে এসব ভুয়া চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলক রঞ্জন সাহা বলেন, ‘আমার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারী এতে জড়িত রয়েছে কিনা, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানানো হয়, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ১৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে জাল চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। সরকারিকরণের এই জাল চিঠির প্রতারক চক্রটি সংশ্লিষ্ট স্কুল এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠায়। চিঠি পাওয়ার পর গত ৮ মে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মন্ত্রণালয়ে নিশ্চিত হতে তালিকা পাঠান। ওই চিঠি পাওয়ার পর স্মারক মিলিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় চিঠিগুলো জাল। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার স্বাক্ষর স্ক্যান করে জাল চিঠি তৈরি করা হয়েছে।

ভুয়া চিঠির ওপর কার্যক্রম না নিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাসরকারি করে দেওয়ার নাম করে জাল স্বাক্ষরে সিরাজগঞ্জের যেসব বিদ্যালয়ের নামে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— গোসাইবাড়ি, কোচগ্রাম, মিটুয়ানি পশ্চিমপাড়া, চরসলিমাবাদ, পূর্বপাড়া, হাটাইল উত্তরপাড়া, চর কোদালিয়া, চরকোদালিয়া পশ্চিম পাড়া, বৈন্যা পশ্চিম পাড়া, পাছ শিমুলিয়া পশ্চিম পাড়া, ফুলহারা, দক্ষিণ খাসকাউলিয়া, দক্ষিণ আগবিয়ানপুর, গাড়া বাড়ি, চর ওমরপুর পশ্চিমপাড়া, কৈরট দক্ষিণপাড়া, পশ্চিম মুরাদপুর ও চৌবাড়িয়া দক্ষিণপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এই স্কুলগুলোর জাল চিঠির বিষয়ে যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা বলেন, ‘জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের সন্দেহ হওয়ায় তারা যাচাইয়ের জন্য আমাদের কাছে তালিকা পাঠান। আমরা যাচাই করে দেখি, এসব স্মারক নম্বরে কোনও বিদ্যালয় সরকারি করা হয়নি।’

এদিকে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বড়িয়াল ও সুনাইকান্দা এবং বারোহাট্টা উপজেলার তাজপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়েছে এমন একটি ভুয়া চিঠি ইস্যু করে প্রতারক চক্র। উপসচিব গোপাল চন্দ দাসের স্বাক্ষর স্ক্যান করে চিঠিটি ইস্যু করা হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা শিক্ষা অফিসার প্রতিবেদন পাঠান মন্ত্রণালয়ে।

মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে দেখে ২৭ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত ৫৬০ নম্বর স্মারকে কোনও চিঠি ইস্যু করা হয়নি। ওইদিন ৭০ নম্বর স্মারকে বিভাগীয় শিক্ষা অফিসে একটি চিঠি পাঠানো হয় অন্য বিষয়ে।

স্কুল সরকারিকরণে মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠির স্মারকের সঙ্গে না মিলিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মন্ত্রণালয়ে জেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদন পাঠালে, তাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। জালিয়াতিরোধে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া জাতীয়করণ সংক্রান্ত জেলা যাচাই-বাছাই কমিটির কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের চিঠি জাল, বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ