অন্ধকারে নাফ নদীর তীরে চার ঘণ্টা

রাতে ছোট নৌকায় করে এভাবেই বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গারাশুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। চারদিকে অন্ধকার। আমি বসে আছি নাফ নদীর তীরে, রোহিঙ্গাদের নৌকার অপেক্ষায়। হঠাৎ অন্ধকারে টর্চের আলো। সঙ্গে থাকা স্থানীয় বরফকলের ফোরম্যান আলী হোসেন বললেন, নৌকা আসছে। নদীর তীর ধরে এগিয়ে গেলাম। হাঁটু পানিতে এসে ভিড়েছে একটি ছোট্ট মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকা। সর্বোচ্চ পাঁচ/ছয়জন বহনকারী নৌকায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছেন ১৩ জন। তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের বস্তা। নৌকার মাঝি লাফ দিয়ে পানিতে নামলেন। নৌকাটি ঢেউরে তালে দুলছে। শক্ত করে ধরলেন মাঝি। নৌকা থেকে নেমে এলেন ১৬ বছরের জাহানারা বিবি। তিনি দুই সন্তানের মা। একজনের বয়স দুই, আরেক জনের আট মাস। এক হাতে একটি বস্তা আর আরেক হাতে ধরে রেখেছেন কোলের সন্তানটিকে। শিশুটি কাঁদছে। হাতে বস্তা থাকার কারণে শিশুটিকে ঠিক মতো কোলে ধরেও রাখতে পারছেন না। পেছনে প্লাস্টিকের বস্তা ও আরেক সন্তান সাদেককে নিয়ে তার স্বামী মোহাম্মদ ইউনূস। তীরের দিকে হাঁটছেন তারা। তাদের সঙ্গে জাহানারার আরও দুই বোন, আছমা খাতুন (২৫) ও সাবেকুর (২০)। সঙ্গে আছেন তাদের স্বামী ও সন্তানরাও। নৌকা থেকে নেমে বালুচরে এসে দাঁড়ালেন তারা।

রোহিঙ্গা-৬সামনে অন্ধকার-অনিশ্চিত ভবিষ্যত, তবুও মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেলো তাদের মধ্যে। যাক, প্রাণ হাতে তবু একটা আপাত নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানো গেলো! হয়তো এমনটাই ভাবছিলেন তারা। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন দুর্বিষহ জীবনের কথা।

জাহানারা বিবির স্বামী ইউনূস রিকশা চালান। তাদের ভাষায় সাইকেল। মংডুর মুন্নীপাড়ায় তাদের বাড়ি। দুই সন্তান নিয়ে সংসারে টানাপড়েন থাকলেও সুখ ছিল তাদের পরিবারে। কিন্তু হঠাৎ সেই সুখের ঘরে নেমে এলো যেন সাক্ষাৎ যমদূত। গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে রাখাইন রাজ্যে চলছে সেনাবাহিনী ও মগদের তাণ্ডব। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে তারা। হত্যা, খুন, ধর্ষণ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে মগ ও সেনারা। ছোট ছোট শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে মারছে। নারীদের গণধর্ষণ করছে। পুরুষদের ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করছে। এইসব দেখে প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কেটেছে তাদের জীবন। সাত দিন আগে তাদের ছোট্ট বাড়িটায় আগুন দিয়েছে মগ-সেনারা। কোনোমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তারা। তারপর বাকি দিনগুলো কেটেছে পাহাড়ের জঙ্গলে-জঙ্গলে, অর্ধাহারে-অনাহারে।

রোহিঙ্গা-৩জাহানারা বিবি জানালেন, একেকটা দিন তাদের কিভাবে কেটেছে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছেন। হাতে কোনও টাকা নেই, নৌকায় পাড়ি দিতে পারছেন না। উত্তরের দিকে গোলাগুলির খবরে দক্ষিণের দিকে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন। আবার দক্ষিণে গোলাগুলির খবর পেলে উত্তর দিকে চলে যান। অবশেষে চেয়ে-চিন্তে মিয়ানমারের কয়েক লাখ কিয়েট জোগাড় করেন। যা দিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিলেন নৌকায়। এখন হাত একেবারেই ফাঁকা। কোথায় যাবেন? কিভাবে যাবেন? কিছুই জানা নেই তাদের। শুধু জানেন এপাড়ে এলে অন্তত জীবনটা বাঁচবে। তাই জীবনের তাগিদে চলে এসেছেন বাংলাদেশে।

রোহিঙ্গা নৌকা ভিড়েছে শুনে স্থানীয় এক যুবক এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাদের পথের নির্দেশনা দিয়ে বললেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এক কোলে শেষ সম্বল প্লাস্টিকের একটি বস্তা, আর অন্য কোলে শিশুটিকে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন জাহানারা। আমরা তীরে ফিরে এলাম রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা পরবর্তী নৌকার অপেক্ষায়।

রোহিঙ্গা-২গত কয়েকদিন ধরেই টেকনাফ থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরের বুকে জেগে ওঠা শাহ্পরীর দ্বীপ দিয়ে রোহিঙ্গা আসার স্রোত বেড়েছে। তাই শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা বসে ছিলাম নাফ নদীর তীরে, বরফকল এলাকায়। আমার সঙ্গে স্থানীয় বরফকলের ফোরম্যান চল্লিশোর্ধ আলী হোসেন। শাহপরীর দ্বীপের অন্তত ১০টি পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা নৌকাগুলো ভিড়ছে। বেশিরভাগ নৌকা আসে সন্ধ্যার পর থেকে। ভোর পর্যন্ত সুযোগ বুঝে, ওপারে মিলিটারি, মগ আর মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) চোখ ফাঁকি দিয়ে আসেন রোহিঙ্গারা।

প্রথম নৌকার মিনিট বিশেক পড়েই এলো আরেকটি নৌকা। আগেরটির তুলনায় আকারে এটি একটু বড়। তবু ১০/১২ জন বহনকারী এ নৌকায় রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। তীরে এসে নৌকা ভেড়াতেই সবাই নেমে এলো একে একে। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ। পানিতে নেমে হেঁটে বালুচড়ে এসে মা রহিমা খাতুন (৬০) ও শাশুড়ি রহিমা খাতুনকে বসিয়ে রেখে ফের জেটি ঘাটের দিকে ছুটলেন ওবায়দুর রহমান। শেষ সম্বল কিছু জিনিসপত্র আর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আসার জন্য। আর দুই বৃদ্ধা বসে আছেন সামনে দুটি বেশ বড় বড় প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে। ওবায়দুর স্ত্রী-সন্তান আর সঙ্গে আনা মালামালগুলো কোথাও রেখে ফিরবেন। তারপর সেখানে নিয়ে যাবেন দুই মাকে।

রোহিঙ্গা-৫কখনও প্লাস্টিকের বস্তায় মাথা ঠেকিয়ে, কখনও হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে কাঁদছিলেন মাহমুদা খাতুন। আর রহিম খাতুন চেয়ে আছেন অন্ধকারে, নদীর দিকে। ওপারে হাঁড়িপাড়ায় তার বাড়ি, যেখানে ফেলে এসেছেন সব স্মৃতি। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার কষ্ট তার বুকে। কিন্তু কোনও কথা বলছেন না। তিনি মাহমুদা খাতুনের মতো কাঁদছেনও না। হয়তো অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে তার হৃদয়। এতদিনের সংসার, তিলে তিলে জমানো সব সম্পদ, সব ফেলে আসা তো সহজেই ভোলা যায় না। মাহমুদা খাতুন ডুকরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘সব শেষ। ওরা লুট করছে। গলা কেটে হত্যা করছে। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না ওদের হাত থেকে। মুসলিম শুনলেই ওরা মারছে, অবর্ণনীয় অত্যাচার করছে। বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে আগুন দিচ্ছে ওরা।’ সৃষ্টিকর্তার কাছে এইসব অন্যায়ের বিচার দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। এরই মধ্যে ফিরে এলেন ওবায়দুল। দুই বৃদ্ধাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন সামনের দিকে।

নাফ নদীর তীরে প্রায় ৮ বছর ধরে বরফকলে কাজ করা আলী হোসেন বলছিলেন, শুধু এই পয়েন্টই নয়, উত্তরের আরও অন্তত তিনটি পয়েন্ট, জেটি ঘাট ও জেটি ঘাটের দক্ষিণে আরও পাঁচ/ছয়টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়ছে শাহপরীর দ্বীপে। শুক্রবার রাতে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে অন্তত তিন থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে তার ধারণা। রাত ছাড়াও নদীতে জোয়ার-ভাটার কারণে অনেক সময় মাঝের একটি চরেও দিনভর অপেক্ষা করতে হয় রোহিঙ্গাদের, নৌকার মাঝিরা চরের মাঝখানে তাদের নামিয়ে দিয়ে যায়। আলী হোসেনের কথার প্রমাণ অবশ্য বিকালেই পাওয়া গেছে। জেটি ঘাট থেকে দূরের একটি চরে অনেক মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখেছি। জোয়ারের পানি কমে এলেই তারা বালুচর দিয়ে হেঁটে আসবেন তীরে।

রোহিঙ্গা-৭রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে পরপর ১০/১২টি নৌকা এসে ভিড়লো শাহপরীর দ্বীপের বরফকল পয়েন্টে। একে একে নেমে এলেন সবাই। নদীর তীরের কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে হাঁটছেন তারা। নাফ নদীর তীরে কাঁচা-পাকা সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হলো আছমিরা খাতুনের (৪০) সঙ্গে। আট সন্তানের জননী আছমিরার কোলে ৪০ দিনের এক শিশু। মংডুর ডাইলপাড়ায় তাদের বাড়ি। স্বামী মাহমুদ ইলিয়াস রিকশাচালক। সাত দিন আগে তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে মগরা। তখনই বড় আর মেজ ছেলে চলে এসেছে বাংলাদেশে। সাত দিন এপাড়া-ওপাড়ায় আত্মগোপনে থেকে তারাও চলে এসেছেন এপাড়ে।

আছমিরা খাতুনের সঙ্গে দুটি প্লাস্টিকের বস্তা। জানালেন, বস্তার ভেতরে তিনটি কম্বল আর কিছু কাপড়। বললেন, পালিয়ে থাকার সময় ঘর ছেড়ে আসা এক বাড়িতে এসব পেয়েছেন বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। নিজের বাড়ি থেকে কিছুই আনতে পারেননি। এখন আট সন্তানসহ দশ জনের পরিবার নিয়ে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলেছেন তারা। আগে খুঁজতে হবে আশ্রয়। তারপর থেকে প্রতিদিনের সংগ্রাম, তিনবেলা না হোক অন্তত এক বেলার খাবার।

রোহিঙ্গা-১আছমার পরিবারের সঙ্গে আমি যখন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, সেখানে নোটপ্যাডে লিখতে দেখে হাঁটা বন্ধ করে জড়ো হয় আরও কিছু রোহিঙ্গা পরিবার। কোলে দেড় মাসের এক শিশুকে নিয়ে তাসলিম আরা বারবার নিজের নামটা লেখার অনুরোধ করছিলেন। ভাবছেন এখানে নাম লেখালেই হয়তো আশ্রয় আর খাবারটুকু জুটবে। আরও তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে স্বামী জাহিদ ছিল পাশেই। মংডুর বমুপাড়ায় তাদের বাড়ি। বললেন, ঈদের এক দিন আগে তাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে মগরা। সেই থেকে এপাড়া-ওপাড়া এর বাড়ি, ওর বাড়ি থেকেছেন। কোলের শিশুটিকে নিয়ে নিদারুন কষ্টে কেটেছে তার দিনরাত। নিজে খেতে না পাওয়ায় কোলের শিশুটিকেও বুকের দুধ খাওয়াতে পারেননি ঠিকমতো। অপর তিন শিশু সন্তানসহ তারা এক বেলা খেয়েছেন তো দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে তাদের।

শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা নাফ নদীর তীরে বসে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার পর যে নির্মম অত্যাচার-নিপীড়নের কথা বলছিলেন, তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করেও বোঝানো কঠিন। স্থানীয় এক তরুণ এন্তাজ বলছিলেন, ওপারে মগ আর সেনারা আসলে মানুষ নয়, ওরা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট। মানুষ হলে মানুষের সঙ্গে এমন কেউ কখনও করতে পারতো না।

আরও পড়ুন:
সন্ধ্যা নামলেই শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গার ঢল
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের রূপরেখা নিয়ে বিএনপির রুদ্ধদ্বার বৈঠক
নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর জোর দিচ্ছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো