অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের ঝুঁকিতে বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকা

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরঅনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকা। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকদের অদক্ষতার কারণে এই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন অ্যাপ্রোন এলাকায় কর্মরতরা। তারা বলছেন, একাধিকবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই এলাকায় যান চলাচলের গতি নির্ধারণ করে দিলেও স্পিড মিটারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় শৃঙ্খলা ফিরছে না। 

বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও চট্টগ্রামের শাহ আমানত  ও  সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বে পালন করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। দেশি এয়ারলাইন্স নিজেদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ নিজস্ব যন্ত্রপাতি ও লোকবলের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থেকে ২৬টি বিদেশি, ৪টি দেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এসব ফ্লাইটের মালামাল লোড-আনলোড, ফুয়েলিং, উড়োজাহাজে যাত্রী ওঠানো, উড়োজাহাজের যান্ত্রিক অনুসন্ধান করাসহ বিভিন্ন কাজ করা হয় বিমানবন্দরের এই অ্যাপ্রোন এলাকায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি উড়োজাহাজ অবতরণের পর অথবা উড্ডয়নের আগে অ্যাপ্রোন এলাকায় অবস্থানকালে  ৪ থেকে ১০টি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়। এছাড়া, উড়োজাহাজের ফুয়েলিং (তেল সরবরাহ) গাড়ি,  ট্রাফিক কন্ট্রোলে কর্মকর্তাদের যানবাহন, যাত্রী পরিবহনে গাড়ি, সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের বহনকারী যানবাহনও অ্যাপ্রোন এলাকায় চলাচল করে।’

20171016_091153

নাম  প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এলাকা স্পর্শকাতর হওয়ায় যান চলাচলে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিসীমা ১৫ কিলোমিটার নির্ধারণ করেছে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। এছাড়া, অ্যাপ্রোন এলাকায় যেসব যানবাহন চলাচল করবে, তার অনুমতি ও চালকদের অনুমতি নিতে হয় সিভিল এভিয়েশন থেকে। তবে বিমানবন্দরে অ্যাপ্রোন এলাকায় যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ১৫ কিলোমিটার নির্ধারিত থাকলেও তা পর্যবেক্ষণে কোনও স্পিড মিটার নেই। যানবাহন ঠিক পথে চলাচল করছে কিনা, চালকদের অনুমোদন আছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণে নেই নির্ধারিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনও কর্মকর্তাও। শুধু বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে কোনও গাড়ির চলাচলের গতিপথ সন্দেহজনক মনে হলেই নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জানানো হয়। কখনও কখনও উড়োজাহাজের ককপিট থেকে পাইলটরা কোনও যানবাহনের অসঙ্গতি দেখলে টাওয়ারকে জানান।’  

SAZ_0485

প্রসঙ্গত, গত ১০ অক্টোবর একটি বেল্ট লোডারের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি (বোয়িং ৭৩৭-৮০০) উড়োজাহাজ। ঢাকা থেকে নেপাল যাওয়ার প্রস্তুতির সময় উড়োজাহাজটির লাগেজ ডোর বন্ধ করার সময় বেল্ট লোডার ঘুরে গেলে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইঞ্জিনের কয়েকটি ব্লেড। এ কারণে উড়োজাহাজটি গ্রাউন্ডেড ছিল বেশ কিছুদিন। গত ৭ সেপ্টেম্বর শাহজালালের অ্যাপ্রোন এলাকা বিমানের যাত্রীবাহী বাসের চালক জিএসই অপারেটর মো. সোহরাব হোসেনকে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে আর্থিক জরিমানাও করে সিভিল এভিয়েশন। গত ৫ আগস্ট  বিমানের জিএসি অপারেটর মো. নজরুল অসতর্কভাবে  গাড়ি চালানোর কারণে বিমানের কার্গো হেলপার মো. সেলিম মারাত্মকভাব পায়ে আঘাত পান। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সেলিমের স্বাভাবিক চলাচলের সক্ষমতা ফিরতে প্রায় তিন বছর চিকিৎসা প্রয়োজন।

SAZ_0427

এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকা খুবই স্পর্শকাতর অঞ্চল। এখানে একইসময়ে একাধিক ফ্লাইট পরিচালনায় অনেক ধরনের যানবাহন চলাচল করে।তবে নিয়ম মেনে পরিচালিত না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শাহাজালালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে বিমানকর্মীদের যতটা দক্ষতা প্রয়োজন, তা নেই। একইসঙ্গে মনিটরিং ব্যবস্থাও দুর্বল। নিয়মিত মনিটরিং না করলে কেউ দায়িত্বে অবহেলা বা  নিরাপত্তা হুমকির মতো কোনও কাজ করলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। গাড়ি কত গতিতে যাচ্ছে, এটা কিভাবে  পর্যবেক্ষণ হবে?  খালি চোখে পরিমাণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য স্পিড মিটার প্রয়োজন। স্পিড মিটার থাকলে উচ্চগতিতে কোনও যানবাহন চলাচল করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা শনাক্ত করা সম্ভব। একইসঙ্গে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো এলাকা নজরদারি করতে হবে, যেন কোনও গাড়ি অনুমতি ছাড়া ঢুকতে না করতে পারে। এসব নিয়মিত মনিটরিং করতে নির্ধারিত লোকবলও থাকতে হবে।’

20171016_101350

বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ বলেন, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে নিয়োজিত কর্মী,  ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ট্রাফিকিং বিভাগের কর্মীরা বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন ও রানওয়ে এলাকায় কাজ করেন। এসব বিভাগের কর্মীদের র‌্যাম্প সেফটি এওয়ারনেস বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই বিমান কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।’

ইতোপূর্বে অতিরিক্ত গতিতে যান চলাচলের জন্য জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য একাধিকবার শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে যান চলাচলের শৃঙ্খলা ও তদারকির জন্য স্পিড মিটার জরুরি। একটি গাড়ি কত গতিতে যাচ্ছে, তা স্পিড মিটার ছাড়া নির্ধারণ সম্ভব নয়।  গ্রাউন্ড সেফটি উন্নয়নে অ্যাপ্রোন ও রানওয়ে এলাকায় যারা কাজ করেন, তাদের নিয়মিত সেফটি ট্রেনিং করানো প্রয়োজন।’

20171016_094938

এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের এটিএস অ্যান্ড এরোড্রামস বিভাগের পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এলাকায় যানবাহনের অনুমোদন নিতে হয়, অনুমোদনবিহীন যান চলাচলের কোনও সুযোগ নেই। আর অনুমোদিত চালকরাই গাড়ি চালানোর সুযোগ পান। কোনও গাড়ি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচল করলে টাওয়ার কন্ট্রোল থেকে দেখা গেলে তা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জানানো হয়। একইসঙ্গে কোনও পাইলট ককপিট থেকে জানালে সেটিও আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সিভিল এভিয়েশন এক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

 ছবি: সাজ্জাদ হোসেন