বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বিকালে অনুষ্ঠিত বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকিতে এসব মন্তব্য করেন আলোচকরা। তারা বলেন, শিশুরা বন্দি জীবনে বেড়ে উঠছে। আকাশ দেখার সুযোগও তারা পাচ্ছে না। সমাজই শিশুদের এই ধরনের বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে চার দেয়ালের মধ্যেও শিশুদের শৈশবকে আনন্দদায়ক ও মজাদার করে তোলা যেতে পারে। এ জন্য অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।
বৈঠকিতে একটি গবেষণার তথ্য দিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘শিশুরা বন্দি জীবনে বেড়ে উঠছে। তাদের আকাশ দেখার কোনও সুযোগ নেই। তারা বেড়ে উঠছে সামাজিক বন্ধনের বাইরে। কারও সঙ্গে মেলামেশার সুযোগও তাদের কম। অসামাজিক শিশু হয়ে তারা বেড়ে উঠছে।’
বৈঠকিতে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় সম্প্রতি একটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৮৩ শতাংশ শিশু চায় তাদের এলাকায় একটি খেলার মাঠ তৈরি হোক,৭৩ শিশু চায় এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠুক,৭৬ শিশু বলেছে এলাকায় শিশুপার্ক হোক। এছাড়া ৩ শতাংশ শিশু চেয়েছে পাঠাগার, ২ শতাংশ শিশু চিড়িয়াখানা চেয়েছে।’
খেলার মাঠের জায়গায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা কিংবা ক্লাবের দখলে খোলা জায়গা চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউন সম্পাদক বলেন, ‘এর বাইরেও বিভিন্ন কারণে শিশুদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তারা জাংকফুড বেশি খাচ্ছে। এর পেছনের কারণ হলো— আমারা অভিভাবকরা সন্তানকে খেলার মাঠে না নিতে পেরে তাদের কোনও শপিং মলে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানেই হয়তো একটি খেলার মাঠ আছে, সেখানে সে খেলছে। পাশেই রয়েছে ফাস্টফুডের দোকান, সেখান থেকেই তাকে খাওয়ানো হচ্ছে জাংকফুড। এতে একটিকে তারা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না,অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যাও তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সন্তান আমাদের সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে দিয়েই বড় হোক। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই। প্রতিযোগিতা হতে হলে আমার সংস্কৃতির মধ্যেই প্রতিযোগিতা করে, এই সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়েই বড় হবে।’
তিনি বলেন, ‘‘মিশেল ফুকো তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ প্রবন্ধে মানুষের বন্দি জীবনের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। আমরা সমাজে যারা বসবাস করি তারা সবাই আসামি, আমরা একেক জন একেকটা খোপ খোপ ঘরে বসবাস করি। ওই সমাজের ওপর রয়েছে লম্বা একটি ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে আমাদের খুপরি ঘরে টর্চ মেরে আসামিরা কে, কী করছি তা দেখে। আমরা সবাই আসলেই এমনই একটি বন্দিদশার মধ্যেই রয়েছি। ফুকো এই আইডিয়াকে বলছেন ‘প্যানোপটিকন’। আমরা আমাদের ঘরেও একই অবস্থায় রয়েছি। আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে ‘প্যানোপটিকনে’র মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘শিশুরা মা-বাবাকে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে। মা-বাবা যা যা করেন, সন্তানও সেগুলোই করতে চায়। আবার সন্তানকে যা করতে নিষেধ করা হয়, সেটা করার দিকেই তার ঝোঁক বেশি থাকে। তাই মনে রাখতে হবে, বাবা-মায়ের মানসিকতার ভেতরে সন্তানকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রবণতা থাকতে হবে।’
প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে রাশেদা রওনক বলেন, ‘আমরা মা-বাবারা অনেক বেশি প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে গিয়েছি বলেই আমরা সন্তানকে সেভাবে সময় দিচ্ছি না। কিন্তু এ চিত্র বদলাতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দু’টি দিন বরাদ্দ রাখতে হবে সন্তানের জন্য, তার কথা শুনতে হবে।’
এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের দেশের অভিভাবকদের অনেকেই জানি না সন্তানকে কিভাবে লালন-পালন করতে হয়। আসলে সন্তানদের লালন-পালনে তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি— গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া ও শিশুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা; পরিপক্কতা অর্জনের জন্য যৌক্তিক চাহিদা বা নিয়ন্ত্রণ এবং সন্তানের স্বাধীনতাকেও মূল্যায়নের মাধ্যমে তার সত্তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। এই তিনটি বিষয় ব্যালান্স করে আমরা অভিভাবকরা চলতে পারলে সন্তানের বিকাশ ভালো হবে।’
অধ্যাপক তাজুল আরও বলেন, ‘একজন শিশুকে তার নিজের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি শেখাতে হবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা দিয়ে অভিভাবকরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন— এমন নয়। অর্থাৎ, শিশুদের তদারকি করতে হবে, কিন্তু খবরদারি করা যাবে না। যেভাবেই হোক, শিশুদের সময় দিতে হবে। তার সঙ্গে গল্প করতে হবে, সম্ভব হলে খেলতে হবে। তাহলেই কেবল তাদের শৈশব অন্তত কিছুটা হলেও সুন্দর হয়ে উঠবে।’
বৈঠকিতে নবনীতা চৌধুরী বলেন, ‘৮০ থেকে ৯০-এর দশকে আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, তখন পাড়া বা মহল্লায় মাঠ থাকলেও চাইলেই আমাদের অনেকেই মাঠে নামিনি, অনেককেই মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি। তখনও অনেকেই ছিলাম যাদের দাদা বাড়ি বা নানা বাড়িতে নিয়মিত যাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই তখনও কিন্তু আমাদের অনেককেই চার দেয়ালে বড় হতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা চাইলেও শিশুদের মাঠে নামতে দিতে পারি না। কারণ স্কুলগুলোতে তো এখন মাঠই নেই।’
ডিবিসি সম্পাদক আরও বলেন, ‘চার দেয়ালের মধ্যে শিশুর সময়কে আমরা যথেষ্ট আনন্দদায়ক ও মজাদার করে তুলতে পারছি কিনা, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। আমরা অভিভাবকরা শিশুকে সারাদিনে কতটুকু সময় দিচ্ছি নাকি একদমই দিচ্ছি না— সেটা ভাবার বিষয়। যা আমরা আমার শিশুকে দেখতে দিচ্ছি, সেটাও কি আমি ধারণ করি?’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সময়ে এসে অনেকেই ফ্ল্যাট বাড়িতে স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছেন। তারা শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় আয়োজন করছেন। এভাবেই চার দেয়ালের মধ্যেও শিশুদের সময়কে আনন্দদায়ক,মজাদার ও বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এটা ঠিকভাবে করতে পারলে সেটাও মন্দের ভালো।’
নবনীতা বলেন, ‘আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা দেখা যায়। এটা করতে গিয়ে সন্তানকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না অনেকের। তারাই বাড়ি ফিরে সন্তানকে বলছেন, আমি এত কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করছি, তুমি আমার কষ্টের মূল্য দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে ওই সন্তান কখন যে বিপথে পা বাড়াচ্ছে, তা আমরা টেরই পাই না। তাই যেভাবেই হোক, সন্তানদের সময় দিতে হবে। তাদের চার দেয়ালের বন্দি জীবনকেও ইন্টারেস্টিং করে তুলতে হবে। মা-বাবা দু’জনকেই সমানভাবে সময় দিতে হবে। কারণ এই প্যারেন্টিংও একটি প্রজেক্ট, যেখানে আমাদের জয়লাভ করতেই হবে।’
রাহুল আনন্দ আরও বলেন, ‘সন্তান তো একটু একটু করে বড় হচ্ছে; লম্বা হচ্ছে, শরীরটা বাড়ছে। কিন্তু শরীরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তো মানসিক বিকাশটাও দরকার। বড় হলেই তো সে ধাক্কা খাবে, খেতে বাধ্য। সবাইকেই এই ধাক্কা খেতে হয়। এই যে শৈশব, এটা একবার চলে গেলে তো ফিরে আসবে না। এই শৈশবের আনন্দটাই আলাদা।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে না পারলে তো তার মধ্যে সৃজনশীলতা তৈরি হবে না। যে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার গল্প শোনেনি, সে কিভাবে বড় হয়ে গল্প লিখবে? সে তো কল্পনার রাজ্যে ঘুরতে পারে না। সে চিন্তা করতে পারে না। শুধু শৈশব নয়, ঘরে বন্দি আমরা নিজেরাও। একটু খোলামেলা কোথাও গিয়ে বসব, একটু নির্মল বাতাস নেবো, সেটার উপায় নেই। ফলে শিশুদের জন্য আলাদা করে সময় দেওয়ার কোনও বিকল্প অভিভাবকদের কাছে নেই।’
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিও থেকে বৈঠকি সরাসরি সম্প্রচার করে এটিএন নিউজ। এছাড়া বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বৈঠকি।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম
আরও পড়ুন-
‘সমাজই শিশুদের বন্দিদশায় ঠেলে দিতে বাধ্য করছে’
‘সন্তানকে আমাদের শৈশবের কাছাকাছি কিছু দিতে চাই’
‘চার দেয়ালে বন্দি শৈশব’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি শুরু
‘শিশুরা বন্দি জীবনে বেড়ে উঠছে, আকাশ দেখার সুযোগ নেই’
‘সন্তান লালন-পালনে এখনকার অভিভাবকরাও অনেকখানি অসহায়’
‘শিশুদের চার দেয়ালের পরিবেশটাই কি যথেষ্ট আনন্দদায়ক করে দিতে পারছি?’