বাকৃবি'র ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাকে শাস্তির বদলে পুরস্কার!

বাকৃবি, ফাইল ছবিবাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) গঠিত তদন্ত কমিটি ‘দুর্নীতিবাজ’ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ‘দুর্নীতিবাজ’ সেই অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ইউছুব আলী মণ্ডলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তাকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ও শিক্ষকদের চিঠি দিয়েছে সেই তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে, এমন ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাকে শাস্তি না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘সংবেদনশীল’ দায়িত্বে আসীন করার মাধ্যমে উপাচার্য নিজের অপকর্মে সহায়তার পুরস্কার দিয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আর উপাচার্য বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা অপরাধীদের মধ্যে কাকে শাস্তি দেওয়া হবে বা কাকে দেওয়া হবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার উপাচার্য রাখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া ওই তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে উপাচার্যের আদেশ অমান্য, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির তিন শতাধিক কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য এবং নৈতিক অবক্ষয়ের অভিযোগ ওঠে। পরে একই বছরের ৮ জুলাই এ অভিযোগ তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে তৎকালীন রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেক, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ইউছুব আলী মণ্ডল এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুল বারেক ও বজলুর রহামানের বিরুদ্ধে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগে দুর্নীতির সত্যতা বেরিয়ে আসে। ইউছুব আলী মণ্ডলকে তৎকালীন রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেকের সব দুর্নীতির পরামর্শদাতা ও তার সব অপকর্মের ডান হাত হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

তদন্ত প্রতিবেদনে রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেককে চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং বাকি কর্মকর্তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতরের বাইরে স্থানান্তরিত করার সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশ অনুযায়ী আব্দুল খালেককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলেও ইউছুব আলী মণ্ডলসহ বাকি কর্মকতাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার আড়াই বছর পর সদ্যবিদায়ী ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউছুব আলীকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ওই কমিটির প্রধান পরেশচন্দ্র মোদক এবং দুই সদস্য পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম ও কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন চিঠি দেন উপাচার্য আলী আকবর বরাবর। পরে গত ১৩ ডিসেম্বর সাধারণ শিক্ষকদের ওই কমিটির তিন সদস্য আরও একটি চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘তার (ইউছুব আলী মণ্ডল) মতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোপনীয় ও সেনসেটিভ পদে দায়িত্ব দেওয়া কতখানি নিরাপদ, তা ভেবে দেখা দরকার।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মোদক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কেবল রেজিস্ট্রারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাকিদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেননি উপাচার্য। বরং উপাচার্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে ইউছুব আলীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করেন বলেও আমরা জানতে পারি। পরে আমরা (ওই তদন্ত কমিটির তিন সদস্য) উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে জানতে চাই। তখন তিনি ইউছুব আলীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন, তাকে (ইউছুব আলী মন্ডল) কখনোই কন্ট্রোলার পদে দায়িত্ব দেবেন না। কিন্তু সবার অগোচরেই তিনি (উপাচার্য) তাকে ঠিকই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মাধম্যে একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃতই করলেন তিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপাচার্য স্বজনপ্রীতি করে ইউছুব আলী মণ্ডলকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে থেকে তিনি এখন সার্টিফিকেট বিক্রি, রেজাল্টে গ্রেড বাড়ানোসহ বিভিন্ন দুর্নীতি করতে পারেন বলেই আমরা আশঙ্কা করছি।’

ওই তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক জাকির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইউছুব আলী মণ্ডলের মতো একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া মোটেই মেনে নিতে পারছি না। শুধু তাই নয়, বলা হচ্ছে যে আমাদের প্রতিবেদনে ইউছুব আলীর বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির প্রমাণ ছিল না। অথচ আমাদের কাছে ওইসব কর্মকর্তার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। আমরা সেই আলোকেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। এমন সংবেদনশীল একটি পদে এমন একজনকে আমরা চাই না। আমাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে তিনি আরও বড় দুর্নীতি করবেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই আমরা মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমেই ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেন বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক আলী আকবর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই কমিটি কেবল রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা (তদন্ত কমিটি) রেজিস্ট্রারসহ অন্য কর্মকর্তাদেরকেও দোষী বলে প্রতিবেদন দিয়েছিল। আমি তো বাকি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করিনি। তাছাড়া রেজিস্ট্রার ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণগুলো খুবই দুর্বল।’ তবে প্রতিবেদনে ইউছুব আলীসহ বাকি কর্মকর্তাদের রেজিস্ট্রার দফতর থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশের কথা স্বীকার করেন তিনি।

ওই তদন্তের প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হলে সেটা আমলে নিয়ে রেজিস্ট্রারকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল এবং নিয়োগ বাণিজ্যে রেজিস্ট্রারের সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু— জানতে চাইলে বাকৃবি উপাচার্য বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল কেবল রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আমি সেটাই করেছি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কতটুকু গ্রহণ করতে হবে এবং কতটুকু গ্রহণ করতে হবে না,  সে এখতিয়ার উপাচার্য রাখেন। ইচ্ছে করলে উপাচার্য প্রতিবেদনের পুরোটাই গ্রহণ করতে পারেন, ইচ্ছে করলে আংশিক গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি পুরো প্রতিবেদনও উপাচার্য বাতিল করতে পারেন।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আবুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও জানি ইউছুব আলী মণ্ডলের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের ফোরামের পক্ষ থেকেও ইউছুব আলী মণ্ডলকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। তাকেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করায় আমরাও অবাক হয়েছি। তবে এটা নিয়ে আমরা আবারও কথা বলব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।’

এদিকে, এসব বিষয়ে জানতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ইউছুব আলী মণ্ডলকে গত এক সপ্তাহ ধরে ফোনে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।