গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স: দুই কোটির কথা থাকলেও আসে ১০ লাখ টাকা

গুলিস্তান কমপ্লেক্সরাজধানীর গুলিস্তান সিনেমা হলের জায়গায় ২০ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ না করে উধাও হয়ে গেছে ডেভেলপার কোম্পানি। ভবনটির ১০ তলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষে সব ফ্লোর ও দোকান বিক্রি করে সরে পড়েছে এক বিএনপি নেতার মালিকানাধীন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স দ্য ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স।  ওই ভবনের জমির মালিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। শতকোটি টাকা মূল্যের এই সম্পত্তি থেকে প্রতি মাসে দুই কোটি টাকা আয় হওয়ার কথা ছিল ট্রাস্টের। তবে বর্তমানে ভাড়া হিসেবে আসে ১০ লাখ টাকা। সব খরচ মিটিয়ে বাকি টাকায় ওই ভবনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও হচ্ছে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান গুলিস্তানের এই সম্পত্তির ওপর ২০ তলা ভবন ‘গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে এক ‘অসম’ চুক্তি করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। চুক্তি অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের পর সব ফ্লোর বিক্রি করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর কল্যাণ ট্রাস্ট পাবে দোকান ক্রেতার কাছ থেকে মাসিক ভাড়া। কিন্তু বর্তমানে যে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে ভবনটির তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভবনের ফ্লোরগুলো বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যান ডেভেলপার কোম্পানির মালিক ও বিএনপি নেতা এ এস এম আলাউদ্দিন।

ভবনের যে কয়টি ফ্লোর নির্মিত হয়েছে সেগুলোর দোকান মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে কিছু ভাড়াও আদায় করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভবন বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার কথা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ট্রাস্টের পাওনা  দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ কোটি টাকা।

২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে কল্যাণ ট্রাস্টের চুক্তি হয়। গুলিস্তান সিনেমা হলের ওই প্লটে জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৬১৪০ একর। চুক্তির দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে তা কল্যাণ ট্রাস্টকে বুঝিয়ে দেওয়া কথা। পরে ‍দুই ধাপে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সে অনুয়ায়ী ২০০৭ সালের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক এ এস এম আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠতে থাকায়, তিনি পালিয়ে যান। এর পর আর ভবনের নির্মাণ কাজ এগায়নি।

দোকান ব্যবসায়ীরা জানান, ভবনের প্রতিটি তলায় ১৯ হাজার বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তলায় নির্মিত দোকানের প্রতি বর্গফুটের মূল্য ১৫ হাজার ৫০০ টাকা, ওপরে চারতলা পর্যন্ত প্রতি বর্গফুটের মূল্য ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। পঞ্চম তলার প্রতি বর্গফুট সাড়ে ১১ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ২০ তলা ভবনের প্রায় সব দোকানপাট বিক্রি করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চলে গেছে। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ফলে বিপাকে পড়েছেন দোকানের ক্রেতারা। বর্তমানে তারা নিজেদের প্রয়োজনে কোটি টাকা খরচ করে ভবনের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করছেন। ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে আরও  অভিযোগ,বিভিন্ন ফ্লোরে দোকানের একই স্পেস একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছে তারা। এছাড়া, নিচতলার পার্কিংয়ের জায়গাও দোকান হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। শপিং কমপ্লেক্স,  কমপ্লেক্সের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাত বীরশ্রেষ্ঠের একটি ম্যুরাল, সেন্ট্রাল এসি, ভবনের মাঝের অংশে একটি জরুরি সিঁড়ি, পুরো ভবনে ওঠা-নামার জন্য কার্গো লিফটসহ ৯টি লিফট, প্রধান গেটে একটি বড় সাইন বোর্ডসহ ৫টি গেটে ৫টি সাইন বোর্ড, জেনারেটর স্থাপন, দোকানের ফ্লোরে টাইলস, ইন্টারনেটের ব্যবস্থা, টেলিফোনের ব্যবস্থা ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। পানি, স্যুয়ারেজ ও বিদ্যুৎ সংযোগ ড্রইং অনুযায়ী করা হয়নি। ভবন বুঝে না পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিমাসে দুই কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছে। দোকান ক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভবনে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, সেসব না থাকায় এই মার্কেটে পর্যাপ্ত ক্রেতা পাচ্ছেন না দোকান মালিকরা। তাছাড়া, অনেকে  দোকান বুঝে না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

গুলিস্তান কমপ্লেক্সসরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির ৯ তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ১০ ও ১১ তলায় শুধু ছাদ ঢালাই দিয়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কল্যাণ ট্রাস্টের এ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এ পর্যন্ত  ভবনটিতে বেশ কয়েকজনকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।

চুক্তি অনুযায়ী ২০ তলা ভবন নির্মাণ শেষে এর প্রতিটি দোকান বা অফিস থেকে ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে দুই কোটি টাকা পাওয়া কথা কল্যাণ ট্রাস্টের। কিন্তু এখন পাচ্ছে মাত্র ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এ টাকায় ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণও করা যাচ্ছে না। এমনকি ভবনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বেতনও মেটানো যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানাধীন সংশ্লিষ্ট ভবনের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ভবনটি নিয়ে যা হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। অতীতের সরকারের একজন মন্ত্রী নিজের স্বার্থে সরকারের এই সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছেন। ভবন থেকে  বর্তমানে যে পরিমাণ ভাড়া আসে, তা দিয়ে আমাদের পাঁচ জন কর্মকর্তার বেতন-ভাতাও হয় না।’

গুলিস্তান কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি দিল মোহাম্মদ খোকার বলেন, ‘কমপ্লেক্সে টাকা বিনিয়োগ করে রাস্তায় বসেছেন ব্যবসায়ীরা।  ৮৪৫ জন দোকানি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোনও শর্তই মানেনি। দোকানগুলো যেভাবে নির্মাণ করার কথা ছিল, সেভাবে করা হয়নি। ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর, বৈদ্যুতিক মিটার  বাবদ অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। অথচ এগুলো ভবন মালিকেরই দেওয়ার কথা। কিন্তু এর জন্য কোনও কাগজপত্র দেওয়া হয়নি। ভবনের ফিলারের অংশসহ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ভবনে ওঠা-নামার জরুরি কোনও সিঁড়ি নেই। ৯টি লিফট লাগানোর কথা থাকলেও আছে মাত্র দুটি। তাও নিম্নমানের। এর মধ্যে আবার একটি অকেজো ছিল। গাড়ি পার্কিং এবং জরুরি নির্গমনের সিঁড়ির জায়গায়ও দোকান করা হয়েছে। ডেভেলপার কোম্পানি চলে যাওয়ার পর ভবনে প্রায় চার লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ছিল। যা তারা পরিশোধ করেন। এছাড়া, ব্যবসায়ীরা ছয় লাখ টাকা খরচ করে ভবনের সেন্ট্রাল সাইনবোর্ড লাগান।’

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তাদের ধরতে পারছে না, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা চিন্তা করে কল্যাণ ট্রাস্টের অনুরোধে আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা ভাড়ার টাকা কল্যাণ ট্রাস্টকে পরিশোধ করতে থাকি। ওই চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে ভবনের বিভিন্ন প্রয়োজন অনুযায়ী দেড় কোটি টাকার মতো ব্যয় করেছি। কল্যাণ ট্রাস্টের সঙ্গে ভাড়াটিয়া চুক্তি অনুযায়ী এ যাবত সাড়ে আট কোটি টাকা পরিশোধ করেছি আমরা। কিন্তু কল্যাণ ট্রাস্ট তাদের চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কোনও সহযোগিতাই করছে না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভবনের প্রশাসক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মুনতাকিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী ভবনের কাজ অর্ধেক শেষ হওয়ার পর ট্রাস্টের সঙ্গে তাদের একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়। তাই ডেভেলপার কোম্পানি কাজ বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি নিয়ে একটি মামলা চলমান আছে। বর্তমানে দোকান ব্যবসায়ীরাই মার্কেটের বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা করেন।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডেভেলপার কোম্পানির মালিক এ এস এম আলাউদ্দিনকে বারবার ফোন করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

আরও পড়ুন:
শান্তিচুক্তি করেছি, বাস্তবায়নের কাজও করে যাচ্ছি: প্রধানমন্ত্রী