সরকারের যান্ত্রিক শব্দের অনুমোদিত মানমাত্রা হচ্ছে মোটরযানের ক্ষেত্রে ৮৫ ডেসিবল (নির্গমন নল থেকে ৭.৫ মিটার দূরত্বে পরিমাপকৃত) ও ১০০ ডেসিবল (নির্গমন নল থেকে ০.৫ মিটার দূরত্বে ৪৫ ডিগ্রি কৌণিক রেখায় পরিমাপকৃত)। সুনসান এলাকাগুলোতে দিনে শব্দের অনুমোদিত মাত্রা ৫০ ডেসিবল (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) ও ৪০ ডেসিবল (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা)।
আবাসিক এলাকায় শব্দের অনুমোদিত মাত্রা দিনে ৫৫ ডেসিবল ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল।
পরিবেশ অধিদফতর পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, দেশের কোথাও কোথাও শব্দের মাত্রা সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবল ও সর্বোচ্চ ১৩০ ডেসিবল পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানগুলো সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় যানবাহনচালিত বিশেষ করে হর্নকে শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. চৌধুরী ইয়াকুব জামাল। তিনি হাসপাতালটির শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। তার কথায়, ‘একটি নির্দিষ্ট ডেসিবলের ওপর শব্দ গেলে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এটা শিশুদের বিরক্তি বাড়িয়ে দেয়। তখন নির্দিষ্ট কোনও কাজে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। মনোসংযোগ চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। একটা বয়স পরে এসব শিশুর কানে বধিরতা দেখা দিতে পারে। শব্দ যখন সহ্যক্ষমতার বাইরে যায় তখন তা কানে সমস্যা বাঁধায়। এমন হলে মনোসংযোগ হারানো, কোনও কিছু শিখে মনে রাখতে না পারা, লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়া ও অস্থিরতা দেখা দেয় শিশুদের মধ্যে।’
সম্প্রতি হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে এখনও এর বিপণন ও ব্যবহার চলছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ সাইফুল আলম। তাদের দাবি, এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
বিএসএমএমইউ’র এই অধ্যাপক বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলেছেন, ‘শিশুদের যথাযথ বেড়ে ওঠার জন্য অবশ্যই হর্নের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার ও গণমাধ্যমের সহযোগিতায় এটা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমাদের সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাহলেই শব্দদূষণ কমে আসবে ও শিশুদের জন্য সুন্দর আগামীর পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে।’
বাপা’র জাতীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘শব্দদূষণ নিয়ে একটি গবেষণার সঙ্গে আমি সরাসরি যুক্ত ছিলাম। তখন আমরা গবেষণায় দেখেছি, শব্দদূষণ হওয়া এলাকায় থাকা গর্ভবতী নারীরা অন্য জায়গার চেয়ে বেশিসংখ্যক পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অপুষ্ট শিশু জন্ম দেয়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ মানুষকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থতা করে ফেলে। অতিরিক্ত শব্দ উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার ও অনিদ্রার কারণ ঘটায়। ক্রমাগত শব্দদূষণের কারণে কানের টিস্যুগুলো ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। তখন স্বাভাবিক শব্দ শোনা যায় না। শিশুদের মধ্যে দেখা দেয় মানসিক ভীতি। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষের করোনারি হার্ট ডিজিজও হতে পারে।’
শিশুর জন্য শব্দদূষণ প্রতিরোধে করণীয় প্রসঙ্গে এই পরিবেশ কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শব্দদূষণ প্রতিরোধে গাড়িচালকদের পাশাপাশি অবশ্যই যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা যে গাড়িতে যাতায়াত করছেন তা থেকে উৎপন্ন শব্দ তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। তাই হর্ন বাজালেই প্রতিবাদ করতে হবে।’
শব্দদূষণ রোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন বাপা’র জাতীয় কমিটির এই সদস্য। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরকে কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘শুধু আলোচনা আর সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করেই এর সমাধান হবে না। দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন