২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে আসার পর টিএসসির কাছেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ড. অভিজিৎকে। এ সময় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষক অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশের পর গোয়েন্দা পুলিশ দীর্ঘদিন তদন্ত করলেও মাস তিনেক আগে সেটির তদন্তভার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জড়িত। এই ঘটনায় সরাসরি জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের অনুসন্ধানে ফারাবী বাদে বাকি ছয়জনের বিষয়ে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিজিৎকে হত্যা করতে হবে বলে লেখালেখি করে খুনিদের উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ফারাবীর বিরুদ্ধে।
আদালতের একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে ফারাবী বাদে বাকি ছয়জনের বেশিরভাগই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছে। তবে কারা কবে জামিন পেয়েছে সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানাতে পারেনি।
অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিটিটিসির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অভিজিৎ রায়ের মামলাটির তদন্তভার পেয়েছি মাত্র মাস তিনেক আগে। এরই মধ্যে আমরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া তিনজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বইমেলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বেশ কয়েকজন খুনিকে শনাক্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৮ জুন মুকুল রানা নামে এক খুনিকে ধরতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালানো হলে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে নিহত হয়। এরপর ওই বছরেরই ২১ আগস্ট সিসিটিভির ফুটেজ অনুযায়ী ৬ জনের ছবি প্রকাশ করা হয়।
সূত্র জানায়, গত বছরের ৬ নভেম্বর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে অভিজিৎ হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া আবু সিদ্দিক সোহেল নামে একজনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। ১৮ নভেম্বর তুরাগের বাউনিয়াবাঁধ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় মোজাম্মেল হোসেন সায়মন ওরফে শাহরিয়ারকে। এরপর ২৫ নভেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠ আমিনবাজার এলাকা থেকে আরাফাত রহমান নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়।
সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার হওয়া এই তিনজনই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্তততার কথা উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। স্বীকারোক্তিতে তাদের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে আরও যারা উপস্থিত ছিল, কারা রেকি করেছিল, কারা সাপোর্টিং টিমের সদস্য হিসেবে আশপাশে উপস্থিত ছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবু সিদ্দিক সোহেল বলেছেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা বইমেলায় যাই, কিন্তু অভিজিৎকে না পেয়ে আমরা চলে আসি। ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি, আবীর, হাসান, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার এলিফ্যান্ট রোডের অফিসে যাই। সায়মন আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আমরা বইমেলায় কে, কোথায় থাকবো, কীভাবে অভিজিৎ রায়কে ফলো করবো। আমরা বইমেলায় যাই। আমি শুদ্ধস্বরের স্টলের কাছাকাছি সামনের দিকে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর সায়মন ভাই আমাকে জানায় অভিজিৎ মেলায় এসেছে। অভিপ্রায় স্টলের সামনে আমরা তাকে দেখি। সায়মন ভাই আবার আবীর ভাই ও হাসানের সঙ্গে কথা বলে। তারপর আমরা বের হয়ে টিএসসি মোড় এলাকায় অবস্থান নেই। রাত অনুমানিক সাড়ে ৮টার সময় অভিজিৎ রায় বইমেলা থেকে বের হলে রাজু ভাস্কর্যের উত্তর-পূর্ব রাস্তার ফুটপাতের ওপর আমাদের সংগঠনের চারজন অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। অভিজিতের স্ত্রী বাধা দিলে তাকেও কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায় তারা। অপস শাখার মুকুল রানা ওরফে শরীফ ভাই এই অপারেশনে নেতৃত্ব দেয়। বড় ভাই (মেজর জিয়া), সেলিম ভাইসহ আমরা ঘটনাস্থলে অপস শাখার লোকদের চারপাশে গার্ড হিসেবে ছিলাম। অপারেশন শেষে আমরা যার যার মতো চলে যাই। বাসায় গিয়ে টেলিভিশনে নিউজ দেখে কনফার্ম হই অভিজিৎ রায় মারা গেছে।’
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া তিনজনের বাইরে জিয়া, সেলিমের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি পাঁচজনের শুধু সাংগঠনিক নাম জানা গেছে। তাদের বিস্তারিত পরিচয় জেনে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আনসারুল্লা বাংলা টিমের সদস্যরা স্লিপার সেল বা কাটআউট পদ্ধতিতে কর্মকাণ্ড চালানোয় একজন আরেকজন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারে না। এটা তাদের সাংগঠনিক কৌশল। এ কারণে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে অন্যদের সাংগঠনিক পরিচয় পাওয়া গেলেও বিস্তারিত পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্যই মূলত মামলাটির তদন্ত শেষ করতে একটু সময় লাগছে।’