সাহসী এক অনন্য নাম প্রিয়ভাষিণী

 

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (ছবি- সংগৃহীত)ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছিলেন একজন ভাস্কর। গাছের শেকড় কীভাবে প্রাণ ফেরায়, তিনি কাজের মাধ্যমে তা করে দেখিয়েছেন। সত্তর শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সৃজনশীল কাজের জগতে প্রবেশ করেন আনমনে। কিন্তু তা হয়ে ওঠে অনন্য। ঠিক তার সাহসের মতো, যা সচরাচর দেখা যায় না। যারা নিবিড়ভাবে তাকে দেখেছেন ও মিশেছেন তারা বলছেন, ১৯৭১ সালে নারীর ওপর নির্যাতনের যে কথা কেউ উচ্চারণ করতো না, প্রিয়ভাষিণী সেই কথা বলে কেবল যে নিজের সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা-ই নয়, তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

মঙ্গলবার (৬ মার্চ) দুপুর পৌনে একটার সময় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নারীর লড়াই ও সংগ্রামের এক ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। প্রিয়ভাষিণী কিডনি, ফুসফুসসহ কয়েকটি জটিল রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন।

তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন নারীনেত্রী খুশি কবীর। তিনি বলেন, ‘ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মানেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, জীবনে যা ঘটেছে, সবার সামনে বলতে পারা সহজ না। এটা যারা তাকে দেখেননি তারা বুঝবেন না। শেষের দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। আমরা এখন কীভাবে ভুলবো, তিনি অনেকের কাছে অনেক হেয় হয়েছেন। তাকে অনেক সময় তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়েছে। কিন্তু অবাক বিষয়, আপা মনে রাখতেন না। নিজের ক্রিয়েটিভ জায়গাগুলো সৃষ্টি করেছেন অসাধারণভাবে। আমরা ভেতর থেকে দেখেছি, তিনি প্রকৃত মানুষ। আমার কাছে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ বললে প্রিয়ভাষিণীর মুখ ভেসে ওঠে।’

তিনি আরও  বলেন, ‘‘তার সাহসী ভূমিকাই তাকে শিখিয়েছে কীভাবে সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম শেষ সময় পর্যন্ত যেকোনও আন্দোলন সংগ্রামে তাকে আসতে হবে জানানো হলে তিনি ‘না’ বলতেন না কোনোদিন।’’

লেখক শাহীন আখতার দীর্ঘদিন একাত্তর নিয়ে কাজ করছেন। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথাগুলো তার কাছে আমানত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের যখন কথা হয়েছে, তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে কথা বলেননি কখনও। অভিমান পুষে রাখতে জানতেন না। দেখা হলেই ওই দিনগুলো (একাত্তর) নিয়ে কথা বলবেন এটিই যেন নির্ধারিত ছিল।’

তিনি বলেন, ‘কীভাবে আমি তাকে নিয়ে শোকের কথা জানাবো।অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে।’

আমাদের সব মুক্ত খোলা আকাশ বন্ধ হয়ে আসছে উল্লেখ করে কবি ও সংস্কৃতিকর্মী লায়লা আফরোজ বলেন, ‘তিনি তার পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে বৃক্ষের উপাদানে অবয়ব তৈরি করতেন, সেই সৃষ্টিশীলতা এমনি এমনি আসে না। এই মানুষটির জীবনসংগ্রাম আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। ভাস্কর্য শিল্পে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কিন্তু তাকে মাপবেন এমন মানুষ আছেন নাকি?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চারপাশ থেকে মুক্তচিন্তার মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন, কিন্তু আমরা কাউকে তৈরি করতে পারছি কিনা, সে প্রশ্ন রয়ে যায়। আমরা একজন প্রকৃত মানুষ এবং যোদ্ধা হারালাম।’

১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতনের কথা প্রিয়ভাষিণী নিজে জানিয়েছেন সবাইকে। কিন্তু এরপর তার নিজের মধ্যে ফিরে আসতে সময় লেগে গিয়েছিল সাত বছর। ১৯৭৭ সালে তিনি নিজেকে আবার ফিরে পান, যখন উপলব্ধি করেন কিছু একটা করতে হবে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ২০১২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘একাকিত্বটা আমাকে মোটেই স্বস্তি দেয় না কখনও কখনও। আমি ভেবেছিলাম প্রকৃতির মধ্যে মিলিয়ে যদি আমি নিজেকে ফিরে পাই। মরে যাওয়া গাছের ডাল আর গাছের গুঁড়িতে প্রাণ ফেরাতে চাইলাম আমি। পেরেছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু নিজেকে ফিরে পেয়েছিলাম। এই নিজেকে ফিরে পাওয়া নারী একসময় থিতু হয়ে সিদ্ধান্ত নেন—তিনি কথা বললেই মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হাজারো নারীর কণ্ঠ শোনা যাবে। যারা বলতে পারছেন না, তাদের হয়ে বলে দেওয়াটাও জাতীয় দায়িত্ব। তিনি শুরু করেন বলতে। আমরা ফিরে পাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আরেক অধ্যায়।