চালকের আসনে বাড়ছে নারীর কদর

চালকের আসনে বাড়ছে নারীর কদরওস্তাদ, বামে প্লাস্টিক। কটমট করে তাকালেন বাসের চালক। ফের হেলপার বললো—ওস্তাদ, ড্রাইভার মহিলা। এই গল্পটি একজন নারী সাংবাদিকের। আগে শহুরে মেয়েদের অনেকে শখের বশে যেমন গাড়ি চালাতেন, এই নারী সাংবাদিকও তেমনই। তবে নারীর গাড়ি চালানোর বিষয়টি এখন আর শখের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা পেশা হয়ে উঠছে। সমাজ যেমন বদলাচ্ছে, পরিবর্তন ঘটছে মানসিকতারও। ড্রাইভিং পেশায় নারীরা এখন সবার সহায়তাও পাচ্ছেন। দিন দিন তাই নারী চালকের কদরও বাড়ছে।

খুব বেশি দিন আগে হয়তো এমনটি ভাবা অসম্ভব ছিল। বস গাড়ির পেছনের সিটে বসবেন, আর চালকের আসনে একজন নারী স্টিয়ারিং ধরবেন—পুরুষ শাসিত সমাজে এই ভাবনা একটু কঠিনই ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও। রাস্তাঘাটে আজকাল মেয়েদের গাড়ি চালানো দেখে কেউ আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন না। কেউ আর বলে না—‘ওস্তাদ, বায়ে প্লাস্টিক, ড্রাইভার মহিলা।’ 

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শরিফুল হাসান বলেন—‘তার নিজের গাড়ির ড্রাইভার একজন নারী। কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বরং পুরুষের তুলনায় ভালোই মনে হচ্ছে।’ সময় আর রাস্তায় নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী চালককেই প্রাধান্য দিলেন তিনি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন দিন কদর বাড়ছে নারী চালকদের। আগে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ড্রাইভার হিসেবে নারীদের প্রাধান্য দিতো। এখন ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে নারী ড্রাইভার খুঁজছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন— পুরুষ ড্রাইভারদের তুলনায় নারীরা শান্ত হয়। সময় মেনে চলার বিষয়েও তারা বেশি মনোযোগী থাকে। একইসঙ্গে তারা নিয়মকানুন মেনে চলার বিষয়েও সিরিয়াস।  

সম্প্রতি নতুন গাড়ি কিনেছেন উপসচিব রেখা রাণী বালো। তিনি একজন নারী ড্রাইভার খুঁজছেন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরুষের তুলনায় নারী ড্রাইভার হলে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।’ এছাড়া, নিজেদের (পরিবারের) নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছেন তিনি।চালকের আসনে বাড়ছে নারীর কদর

রেখা রাণী বালো জানান, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ড্রাইভিংয়ে এগিয়ে আসছে, যা লক্ষণীয় বিষয়। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যও ড্রাইভারের পদে একজন নারীকেই নিয়োগ দিতে চান তিনি।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের গাড়িচালক মিনতি প্রভা চাকমা বলেন, ‘আগে ব্র্যাকে অন্য পদে চাকরি করতাম। হঠাৎ করেই ব্র্যাক নারীদের জন্য ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ শুরু করে। নিজের আগ্রহ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর চাকরির প্রস্তাব আসে।’ মিনতি প্রভা চাকমা পাঁচ বছর ধরে ড্রাইভারের পেশায় যুক্ত আছেন।

মিনতি জানান, রাঙ্গামাটি থেকে এইচএসসি পাস করে  ঢাকায় এসে প্রথমে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন। আর এখন তিনি রীতিমত পেশাদার ড্রাইভার। এই পেশায় আসার বিষয়ে পরিবারের কোনও আপত্তি বা বাধা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ আপত্তি করেনি। বরং অনেক মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছে। ড্রাইভিং এখন আর শুধু পুরুষদের পেশা নেই। নারীরাও সমানভাবে এগিয়ে আসছে। এরকম বহু পেশায় এখন নারীরা প্রবেশ করছেন।’

নিজের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে মিনতি প্রভা চাকমা বলেন, ‘শহরের মধ্যেই গাড়ি চালাই। শহরের বাইরে এখনও যাইনি।’ পাশাপাশি যাদের গাড়ি চালান, তাদের সহযোগিতার কারণেও এই পেশা তার জন্য সহজ হয়েছে বলে তিনি জানান।
থানচেলি পাংখুয়া। ২০০৮ সাল থেকে তিনিও ব্র্যাকে ড্রাইভার পদে চাকরি করে আসছেন। দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। বিয়ের আগে থেকেই ড্রাইভিং শুরু করেন। তার স্বামীও একই পেশায় আছেন। ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় এ পর্যন্ত কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। বরং সবার সহযোগিতা পেয়েই এই পেশায় আছেন তিনি।

থানচেলি পাংখুয়া বলেন, ‘সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। আগের মতো আর নেই। পুরুষের পাশাপাশি এখন নারীরাও ড্রাইভিং পেশায় এগিয়ে আসছে।’

ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসেইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নারীদের জন্য দু’ধরনের প্রশিক্ষণ দেই। প্রফেশনাল এবং নন-প্রফেশনাল। যে কেউ টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। আমরা একটি নন-প্রফেশনাল লাইসেন্সও দিয়ে থাকি। অন্যদিকে, প্রফেশনাল প্রশিক্ষণে গরিব মেয়েদেরও আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি, যাতে তারা সাবলম্বী হতে পারে।’

তিনি বলেন, ব্র্যাক এ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ জন নারীকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জন্য বর্তমানে ব্র্যাকেই কর্মরত আছেন। অন্যরা দেশের নানা প্রান্তে কাজ করছেন।’